ajbarta24@gmail.com রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪
৮ পৌষ ১৪৩১

সিজিএস সংলাপে মাতমত

পুলিশের সংস্কারে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১২ এএম

ছবি সংগৃহীত

গত ১৫ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। কখনো কখনো পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে এমপি-মন্ত্রীদের থেকেও শক্তিশালী দেখা গেছে। জুলাই-আগস্টে পুলিশ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তাই পুলিশে সংস্কার দরকার। কিন্তু সে সংস্কার করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে পুলিশ সংস্কার ফলপ্রসূ হবে না।

গত ১৫ বছরে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। কখনো কখনো পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে এমপি-মন্ত্রীদের থেকেও শক্তিশালী দেখা গেছে। জুলাই-আগস্টে পুলিশ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তাই পুলিশে সংস্কার দরকার। কিন্তু সে সংস্কার করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে পুলিশ সংস্কার ফলপ্রসূ হবে না।

গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তেন এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করেন সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সংলাপে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সাবেক আইজিপি এম এনামুল হক, সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, সিজিএস-এর চেয়ার মুনিরা খান, সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান, সাবেক জজ, কলামিস্ট ও আইনি পরামর্শদাতা ইকতেদার আহমেদ, অধিকারের পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিন এলান, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যরিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান, সমকালের প্রকাশক ও ব্যবসায়ী নেতা একে আজাদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সাফকাত মুনির, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, রাষ্ট্র সমন্বয়ক আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার, শিক্ষক ড. মাহবুবুর রহমান, সাইমি ওয়াদুদ, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. জারিফ রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী রাকিব হোসেন এবং রেজওয়ানা রশীদ। শুরুতে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো সুশাসনের অভাব। সংস্কার শব্দটি অনেক ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এটি ঘৃণিত শব্দে পরিণত হয়েছে। সংস্কার চলনীয় একটি প্রক্রিয়া। আমরা সাধারণ মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছে না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, সার্বিকভাবে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঠিক করা যায় তার ওপর নজর দিতে হবে। কেবল পুলিশের ওপর নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমিশনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে কমিশনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। বর্তমান প্রযুক্তিগুলো পুলিশকে শিখাতে হবে। জনগণেরও পুলিশকে সাহায্য করতে হবে। পুলিশের কাজের তদারকি করার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্লামেন্টে পুলিশের কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি করতে হবে। পর্যালোচনা প্রক্রিয়া আনতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। এডভোকেসি গ্রুপগুলোকে সাহায্য করতে হবে যেন ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করতে পারে। জনগণকে তাদের দাবি তুলে ধরতে হবে যেন সেই দাবিগুলো তারা পূরণ করতে পারে।

জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বিগত সরকার এমন আভাষ দিয়েছে যে তারা ক্ষমতায় না থাকলে অনেক মানুষ মারা যাবে। পুলিশের সেবা না কি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ দরকার? এখানে কাজ করতে হবে। পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে যেন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ না হয়। এম এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে না বলার সাহস থাকতে হবে সবার যদি তা আপনার বিবেকে বেঁধে থাকে। প্রয়োজনবোধে সাহস করতে হবে। কমিশন আগেও হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি। তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, স্কুলে পুলিশের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্তিকরণে কিছু সমস্যা আছে। সাংস্কৃতিক আত্মস্থকরণ দরকার। এটি করতে সময় লাগবে। ভোট দেয়ার অধিকার সবচেয়ে উপরে থাকবে। পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। বিচার সব জায়গায় থাকতে হবে কেবল পুলিশের ক্ষেত্রেই নয়। যারা নির্দেশ দিয়েছে ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে তাদেরকেও ক্ষমা চাইতে হবে ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ইতিবাচক কর্তৃত্বভীতি থাকতে হবে। অতিরিক্ত জোর প্রয়োগ যেন কেউ আর না করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

মো. জারিফ রহমান বলেন, পুলিশ ও জনগণের মাঝে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে জুলাই- আগস্ট গনঅভভুথানে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করেছে। কিন্তু দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এটার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে কমিউনিটি পর্যায় থেকে। এখানে নজর দিতে হবে। চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স কমিউনিটি পর্যায় থেকে শুরু করলে অন্য কেউ জুলাই-আগস্টের মতো কিছু করতে চাইলেও তা পারবে না।

কমিশনে এমন মানুষ থাকতে হবে যারা চাপিয়ে দেয়া নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে। রেজওয়ানা রশীদ বলেন, পুনর্গঠন রাতারাতি পরিবর্তন হবে এমন চিন্তা থেকে বের হতে হবে। এটার জন্য গোঁড়া থেকে কাজ করতে হবে। কমিউনিটি পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে হলে পুলিশ এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে স্কুল পাঠ্যক্রমে। মহিলা ও আদিবাসীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এএসএম নাসিরুদ্দিন এলান বলেন, পুলিশ গত ১৫ বছর অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। তারা দায়মুক্ত ছিল যা বিগত সরকার দিয়েছে। জুলাই-আগস্টের পর পুলিশের মনোবল কমে গেছে। আমরা যেই সংস্কারের দিকে যেতে চাচ্ছি সেদিকে যেতে পারছি না। এরপর যেই সরকার আসবে তারা যদি সংস্কার না করতে পারে তবে আমরা আবার ফ্যাসিজম দেখতে পাব। একে আজাদ বলেন, ৫২ থেকে এই পর্যন্ত পুলিশের তুলনা করে দেখেন তার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি? পুলিশকে এই পর্যায়ে কে নিয়ে গেল? এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। পুলিশকে অমানবিক কাজে নিয়োজিত করা যাবে না। র‍্যাবকে বিলুপ্ত করতে হবে। এগুলো না করলে এটা চলতেই থাকবে। উষাতন তালুকদার বলেন, আমরা বলি দেশের মালিক জনগণ। কিন্তু আসলেই কি তাই? যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তারা কার স্বার্থে কাজ করে? পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে তার দলীয় পরিচয় দেখা যাবে না। যারা ক্যাডার হয় তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধ ঠিক করতে হবে। সেনাবাহিনী থেকে র‍্যাবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। গায়েবি মামলা নিয়ে বর্তমান সরকার কিছু করেনি। পুলিশের বেতনভাতা বাড়ানো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে পুলিশের ক্ষমতা জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।

রাশনা ইমাম বলেন, আইনি অবকাঠামো পরিবর্তন করা হয়নি। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। এগুলো মানা হয় না। বিচার বিভাগে রিট করা হয় যে পুলিশ যেন ছাত্রদের ওপর আক্রমণ না করে। কিন্তু তা পরে খারিজ করে দেয়া হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই। আইনি সংস্কার দরকার কিন্তু তা ঢালাওভাবে করা যাবে না। প্রাধান্য অনুসারে করতে হবে। ইকতেদার আহমেদ বলেন, পুলিশের সংজ্ঞা ঠিক করতে হবে। অতীতে এবং বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে কাজ করছে। এরকম হতে থাকলে দেশে কখনো গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারবে না। আইন কমিশনে আসবে পিএইচডি করা ব্যক্তি। বিগত সরকার তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য কিছু বিচারককে নিয়োগ করেছিল।

আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আমাদের দেশে একজন ভালো রাজনীতিবিদ দরকার। ভালো মানুষদেরকে সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষদের ক্ষমতায় আনবে। মুনিরা খান বলেন, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন এখন ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত সবাই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। অন্যায়কারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচার বিভাগের সাথে পুলিশের সমন্বয় করতে হবে। পুলিশ একজনকে ধরে নিয়ে যায় কিন্তু পরে সে ম্যাজিস্ট্রেটকে টাকা দিয়ে বের হয়ে যায়। এমনটি যেন না হয়।

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর