জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেনের জীবন থেমে গেলো একটি নির্মম পরিকল্পনার শিকার হয়ে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার এক ভবনের সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিলো তার রক্ত, আর তার পাশে পড়ে ছিল এক অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসভঙ্গের করুণ পরিণতি।
পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের ছাত্র জোবায়েদ শুধু একজন ছাত্রনেতা নন, ছিলেন ছাত্রকল্যাণের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকও। কুমিল্লা জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সভাপতির দায়িত্বে থাকা জোবায়েদ গত এক বছর ধরে আরমানিটোলার একটি বাসায় এক উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতেন। তার নাম বর্ষা সেই ছাত্রীই পরিণত হয় তার মৃত্যুর অন্যতম পরিকল্পনাকারীতে।
বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, প্রায় এক মাস আগে, ২৫ সেপ্টেম্বর থেকেই বর্ষা ও তার সাবেক প্রেমিক মাহির রহমান জোবায়েদকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। মাহিরের সঙ্গে বর্ষার নয় বছরের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর বর্ষা জড়ান জোবায়েদের সঙ্গে। কিন্তু সেই সম্পর্কও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একসময় বর্ষা জানান, তিনি আর জোবায়েদকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত ছিলো অশান্তির শুরু।
মাহির তখনো বর্ষাকে ভালোবাসতো। বর্ষার সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগের পর তারা দুজন একসঙ্গে জোবায়েদকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সময় টা তখন দুপুর,থমথমে পরিবেশ চারিদিকে, যেন সারাদিনের ক্লান্তির মাঝে একফোঁটা বিশ্রাম নিচ্ছে সবাই।
এর মাঝেই বর্ষা প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ডাক দেয় জোবায়েদকে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিন, মাহিরের সঙ্গে ছিল তার এক বন্ধু। তারা নতুন করে দুটি সুইচ গিয়ার ছুরি কেনে, এবং বর্ষার বাসার গলির সামনে জোবায়েদের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে
রোববার বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে, যখন জোবায়েদ বর্ষার বাসার তিন তলায় উঠছিলেন, তখনই চালানো হয় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত।
এক মুহূর্তে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বাচার চেষ্টায় উপরে উঠতে গিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেদিন যেন ভাগ্য কনোভাবেই তার সহায় হয়নি।
স্থানীয়রা তার পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহ দেখে পুলিশকে খবর দেয়। বাসার নিচ তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত সিঁড়ি জুড়ে ছিলো রক্তের দাগ। তিন তলার সিঁড়িতে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন জোবায়েদ। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করে পাঠানো হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে।
সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে পুলিশ দ্রুত শনাক্ত করে অভিযুক্তদের। বর্ষাকে সঙ্গে সঙ্গেই হেফাজতে নেওয়া হয়। প্রধান অভিযুক্ত মাহির রহমানকে তার মা নিজেই থানায় সোপর্দ করেন। পরে গ্রেপ্তার করা হয় মাহিরের বন্ধু ফারদিন আহম্মেদ আয়লানকেও।
জিজ্ঞাসাবাদে শুরুতে বর্ষা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার না করলেও মাহির ও বর্ষাকে মুখোমুখি করলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সত্য। প্রেমের দ্বন্দ্ব ও প্রতিশোধস্পৃহাই শেষ পর্যন্ত একটি তরুণ প্রাণ কেড়ে নেয়।
জোবায়েদের মৃত্যুর খবরে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি সভা ডেকে একদিনের শোক দিবস ঘোষণা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান স্থগিত করে।
২১ ও ২২ অক্টোবর দুই দিনের শোক পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। শোকের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয় শোকসভা এবং দ্বিতীয় দিনে আয়োজন করা হয় শোক র্যালির।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, “জোবায়েদের মৃত্যু আমাদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। সাজসজ্জা থাকলেও এবারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী দিবসে কোনো আলো জ্বলবে না। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।”
শিক্ষকদের মধ্যেও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন বলেন, “জোবায়েদ আমাদের সন্তান। তার নির্মম হত্যার বিচার না হলে আমরা পুরো পুরান ঢাকা অচল করে দেব।”
এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর জোবায়েদের ভাই বাদী হয়ে বংশাল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামি করা হয়েছে বর্ষা, মাহির এবং ফারদিনকে। পুলিশের মতে, তারা সবাই পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
একটি তরুণ মেধাবীর এমন করুণ পরিণতি কেবল তার পরিবার নয়, পুরো ক্যাম্পাস ও সমাজকে হতবাক করেছে। প্রেম, হিংসা আর প্রতিশোধের ভয়ঙ্কর এই চক্র ভেঙে দিতে দরকার শিক্ষা, সহমর্মিতা এবং আইন প্রয়োগের কার্যকরতা।
জোবায়েদ আজ নেই, কিন্তু তার শূন্যতা বলে যাচ্ছে, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতিহিংসা আর বিকৃত সম্পর্কের জালে জড়িয়ে নতুন প্রজন্ম আজ কতটা বিপন্ন।
মন্তব্য করুন: