বাংলাদেশের রাজনীতির এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের করুণ যতিচিহ্ন। যিনি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে 'আপসহীন নেত্রী' উপাধি পেয়েছিলেন, আজ সেই জননন্দিত নেত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জীবনের পরম সত্যের কাছে নীরব আত্মসমর্পণ করলেন।
এই প্রস্থান, শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক নেত্রীর বিদায় নয়, এটি সংগ্রাম, ধৈর্য আর সীমাহীন ত্যাগের এক করুণ গল্পের শেষ পাতা। দেশবাসীর হৃদয়ে আজ তাই গভীর শোক আর মর্মবেদনার ছায়া।
রাজনীতিকদের জীবনে উত্থান-পতন সহ থাকে, মামলা, কারাবাস ও সীমাহিন নির্যাতন। কিন্তু খালেদা জিয়ার জীবনকে যেন নিয়তি লিখেছিল আরও কঠিন এক আঁচড়ে। স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রিয় কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর প্রয়াণের গভীর শোক তিনি বহন করেছেন বছরের পর বছর। এরপর দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও রোগযন্ত্রণা তাঁকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে। ১৯৭১ সালের কঠিন সময়ে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে তাঁর আত্মগোপন, আবার রাজনৈতিক জীবনে বারবার কারাবাস, প্রতিটি ধাপে তাঁর সহ্যশক্তিকে যেন পরীক্ষা করা হয়েছে।
এইসব আঘাতের সত্ত্বেও, ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর বহু স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার দিনও গণমাধ্যমের সামনে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেশবাসী দেখেছিল এক নিদারুণ ধৈর্য ও আত্মমর্যাদার প্রতিচ্ছবি। অনমনীয় দৃঢ়তায় অটল থেকে তিনি মাথা উঁচু করে জীবনের পথ হেঁটেছেন। তাঁর এই চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁকে মহৎ চরিত্রগুলোর মতো মহীয়ান করে তুলেছে।
১৯৬০ সালে সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন শুরু হয়। ৩৬ বছর বয়সে বৈধব্য বরণ করার পর, ভাগ্যের অনিবার্য পরিণতিতে তিনি রাজনীতিতে পা রাখেন। একসময়কার গৃহবধূ, দলের শীর্ষ পদ লাভ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাতদলীয় ঐক্যজোটের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জাতিকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আপসহীন নেত্রী’।
দিনাজপুরের বালুবাড়ির সেই 'পুতুল' ডাকনামের মেয়েটি, যিনি ফুল ভালোবাসতেন, পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন, তাঁর রাজনীতিকেও অনেকে সৌন্দর্যমণ্ডিত বলে মনে করতেন। দেশের প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জনগণের কাছে যাওয়ার অদম্য শক্তি তাঁকে দিয়েছিল এক অনন্য পরিচিতি।
কিন্তু শেষমেশ, চলতি বছরের জানুয়ারিতে কিছুটা উন্নতি হলেও নানাবিধ রোগের জটিলতা এবং শরীর-মনের বহু ধকল তাঁকে দুর্বল করে দিয়েছিল। অবশেষে, গত ২৩ নভেম্বর এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষবারের মতো ভর্তি হয়ে তিনি আর চিকিৎসায় সাড়া দিলেন না। দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ‘দেশনেত্রী’ চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে। রেখে গেলেন এক অনমনীয় নেত্রীর আখ্যান, যা হয়তো দীর্ঘকাল ধরে এই দেশের কোটি মানুষের স্মৃতিতে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকবে।
মন্তব্য করুন: