গত দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এক আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। তবে আজকের এই সংকটমূলক পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল বহু বছর আগে, এক সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়তা করেছিল।
এই সহায়তার পেছনে ছিল ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ নামক এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্যোগ এক বিপরীত বাস্তবতায় রূপ নেয়, যেখানে এখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সামরিক হামলারও আশ্রয় নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতা আজকের পরিস্থিতিকে বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৩ সালে জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) প্রকাশ করে যে, ইরান গোপনে ১৮ বছর ধরে একটি পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ছিল একাধিক বৃহৎ ও উন্নতমানের পারমাণবিক স্থাপনা। ইরান যদিও দাবি করেছিল এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, তবে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ ছিল—তেহরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছে। এই সন্দেহের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের আশঙ্কা কাজ করছিল। একে কেন্দ্র করেই শুরু হয় নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক হস্তক্ষেপের ধারা। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ, ওবামা, ট্রাম্প ও বাইডেন—এই চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে, যখন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গোড়াপত্তন ঘটে ১৯৫৩ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার জাতিসংঘে এক ভাষণে “Atoms for Peace” বা “শান্তির জন্য পরমাণু” উদ্যোগের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক প্রযুক্তিকে সামরিকের বদলে মানবকল্যাণে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এর আওতায় ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানে--র মধ্যে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি হয়, এবং তেহরানে গবেষণা চুল্লি স্থাপন করা হয়। সেই সময় ইরানের শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, যিনি এই চুক্তিকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে দেখেছিলেন।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গবেষণা চুল্লি দেয় এবং সঙ্গে দেয় উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম। ১৯৭০ সালে ইরান NPT-তে স্বাক্ষর করে পারমাণবিক অস্ত্র না তৈরির প্রতিশ্রুতি দেয়। তবুও, শাহ ব্যক্তিগতভাবে মনে করতেন যে, যদি পরিস্থিতির প্রয়োজন পড়ে, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটতেই হবে। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৪ সালে গঠিত হয় ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা। শাহ ঘোষণা দেন ২০ বছরের মধ্যে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা। কিন্তু প্রয়োজনীয় দক্ষ বিজ্ঞানীর অভাব প্রকল্পের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
এই ঘাটতি পূরণে ১৯৭৪ সালে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি-কে অনুরোধ করে একটি মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করতে। এতে ইরান ১৩ লাখ ডলার প্রদান করে, যার মাধ্যমে পারমাণবিক প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এমআইটি-র শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান, কারণ শাহের মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড নিয়ে উদ্বেগ ছিল। বিপ্লবের পর এই প্রকল্প ও সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। যেসব ইরানি শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে বিপ্লবের পক্ষে অবস্থান নেন। গঠিত হয় আরিয়ামেহর ইউনিভার্সিটি, যা হয়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতা হারান এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হয়। প্রথমে তারা পারমাণবিক কর্মসূচিকে ‘সাদা হাতি’ বা অকার্যকর বলে প্রত্যাখ্যান করে। অনেক প্রশিক্ষিত অধ্যাপক দেশ ত্যাগ করেন। একপর্যায়ে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত এই প্রকল্প পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী নেতৃত্ব বুঝতে শুরু করে পারমাণবিক প্রযুক্তির কৌশলগত গুরুত্ব। এরপর থেকে তারা গোপনে কর্মসূচি গড়ে তোলে এবং নতুন বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে থাকে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘Atoms for Peace’ প্রকল্প এক দ্বৈত ফল বয়ে আনে—একদিকে এটি শান্তিপূর্ণ গবেষণার সুযোগ তৈরি করে, অন্যদিকে এর ছায়াতেই গড়ে ওঠে অস্ত্র তৈরির পথ।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আজকে এক উদ্বেগজনক চিত্র আঁকে, যেখানে শান্তির লক্ষ্য থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সামরিক সংঘাত পর্যন্ত গড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা ইঙ্গিত দেয়, পারমাণবিক অবকাঠামো অকার্যকর করার জন্য তারা শেষপর্যন্ত সামরিক পদক্ষেপকেও বৈধ মনে করছে। তবে এই উত্তাল পরিস্থিতির মূল সূত্র লুকিয়ে রয়েছে সেই ১৯৫০-এর দশকে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ‘শান্তির জন্য পরমাণু’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইরানকে প্রথম এই প্রযুক্তির পথে নিয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের এই জটিল ও বিপরীতধর্মী গতি বর্তমান বিশ্বে পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমা ও নীতিমালাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার আহ্বান জানায়।
সোর্স: ইনকিলাব
মন্তব্য করুন: