ajbarta24@gmail.com মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি ২০২৫
২৪ পৌষ ১৪৩১

সাজেদার ২ ছেলে ছিলেন ১৪ বছর স্বঘোষিত এমপি


প্রকাশিত: ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:১০ পিএম

আয়মন আকবর ও শাহদাব আকবর

মায়ের ক্ষমতাবলে এই দুই সহোদর ভাই অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এর মধ্যে টানা ১০ বছর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবলু চৌধুরী।

 

টানা ১৪ বছর ফরিদপুর-২ আসনের স্বঘোষিত এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেত্রী সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর বড় ছেলে আয়মন আকবর বাবলু চৌধুরী ও ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। মায়ের ক্ষমতাবলে এই দুই সহোদর ভাই অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। এর মধ্যে টানা ১০ বছর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবলু চৌধুরী।

একপর্যায় জনরোষে বাবলু চৌধুরী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে তার জায়গা দখলে নেন ছোট ভাই লাবু চৌধুরী।

তবে তার বিরুদ্ধেও রয়েছে অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। তিনিও মায়ের ক্ষমতা খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ি ও অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তারা দুই ভাই যে যখন মায়ের নির্বাচনীয় এলাকা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, সে তখন দুর্নীতির মাধ্যমে শুধু সম্পদই করেছেন। জনস্বার্থে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর বয়সের ভারে নুয়ে পড়েন ফরিদপুর-২ (সালথা-নগরকান্দা) আসনের একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি বয়সের ভারে অসুস্থ থাকলেও এই আসনে ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা এমপি ছিলেন। তবে অসুস্থতার কারণে নিজ নির্বাচনী এলাকায় তেমন সময় দিতে পারতেন না। এমন অবস্থায় প্রথমে তার বড় ছেলে বাবলু চৌধুরীকে নিজের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনী এলাকা দেখভালের দায়িত্ব দেন।

দায়িত্ব নিয়েই বাবলু চৌধুরী তার মায়ের নির্বাচনী এলাকায় রাম রাজত্ব শুরু করেন।

অসুস্থ মায়ের চেয়ার দখলে নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সালথা ও নগরকান্দা নিয়ন্ত্রণ করেন বাবলু চৌধুরী। এই পুরো সময়টা বাবলু চৌধুরী অপকর্মের সব পথে হাটতে থাকেন। স্থানীয় যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে মামা বাহিনী নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেন তিনি। ওই বাহিনী দিয়ে নিজ দলীয় ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে থাকেন।

কেউ তার বিরুদ্ধে টুশব্দ করলে হাতুড়ি পেটা করে তার হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দিতেন। সেই সঙ্গে তার বাড়িঘর ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হতো। বাবলুর নির্দেশে এভাবে শতশত মানুষকে নির্যাতন করা হয়েছে। ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে হাজারো মানুষের বসত-বাড়িঘর।

এমনকি বাবলুর হাত থেকে তখন রেহাই পাইনি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। সালথা প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মো. সেলিম মোল্যা ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদের ওপরও নির্যাতন করা হয়। মামলা দিয়ে টানা ৩ বছর এলাকা ছাড়া করে রাখা হয় তাদের। এ ছাড়া স্থানীয় সাংবাদিক আবু নাসের হুসাইন ও এমকিউ বুলবুলের ওপরও হামলা করে এই মামা বাহিনী। সেই সময় বাবলুর ভয়ে কাঁপতেন সালথা ও নগরকান্দার সব শ্রেণির মানুষ। মনে হতো তিনিও এমপি। পুলিশ-প্রশাসনও তাকেই এমপি মনে করতেন। তাই তার নির্দেশে বাইরে কোনো কাজ করতেন না।

অভিযোগ রয়েছে, টানা ১০ বছর মায়ের ক্ষমতাবলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি দপ্তর থেকে কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর-কাবিখা ও ত্রাণের প্রকল্প হরিলুট করে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বাবলু চৌধুরী। এ ছাড়াও ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য করে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। এমনকি অসুস্থ মা সাজেদা চৌধুরীর বেতন-ভাতাসহ নানা সরকারি সুবিধার অর্থ উত্তোলন করে নিয়ে নিতেন তিনি। এভাবে দুর্নীতি করে ঢাকার বনানীতে ৮ তলা একটি আলিশান বাড়িসহ দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েন বাবলু।

বাবলু চৌধুরীর জুলুম-নির্যাতনে অতীষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে নিজ দলের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে নামেন। একপর্যায় তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে তার জায়গা দখলে নেন ছোট ভাই শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী। তবে তিনিও মায়ের নির্বাচনী এলাকা দেখভালের দায়িত্ব পেয়ে ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত স্বঘোষিত এমপি ছিলেন। তবে ২০২২ সালে ১১ সেপ্টেম্বর সাজেদা চৌধুরী মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে লাবু চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হন।

এরপর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে আবারও এমপি নির্বাচিত হন লাবু চৌধুরী। তবে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পর লাবু চৌধুরী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, ভাই বাবলু চৌধুরীর মতো তিনিও টানা ৫-৬ বছর সালথা-নগরকান্দার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যে কারণে তারও সম্পদের অভাব নেই। লাবু চৌধুরীর ঢাকার ধানমণ্ডিতে দুটি ফ্লাট, উত্তরায় ৮ কাঠাসহ জমি, বিদেশে বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পাদক রয়েছে।

সচেতন মহলের দাবি, বর্তমান সরকার যদি তাদের দুই ভাইয়ের সম্পদের অনুসন্ধান করে তাহলে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলে ১৪টি বছর সালথা ও নগরকান্দায় অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। আমার বড় ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন মিয়া ও আমার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে তারা দুই ভাই। আমরা দলীয় লোক হওয়ার পরেও অন্তত মিথ্যা ১০টি মামলা দিয়েছে আমাদের নামে। জনসমাবেশে সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিততে আমার বড় ভাইকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করেছে তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। এরপর তাকে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। তিনি এক বছর জেল খেটে বের হন। এ ছাড়া আমাদের বাড়ি ও মার্কেটে হামলা হয়েছে তাদের দুই ভাইয়ের নির্দেশে। তারা অসুস্থ মাকে পুঁজি করে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে।’

নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত আলী শরিফ বলেন, ‘এমপি না হয়েও তারা মায়ের ক্ষমতাবলে দীর্ঘ ১৪টি বছর সালথা ও নগরকান্দার মানুষকে শাসন করেছেন। মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছেন। বিশেষ করে বিএনপির শতশত নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করে রেখেছেন বছরের পর বছর। পাশাপাশি দুর্নীতি-অনিয়ম করে বিপুল সম্পদ বানিয়েছেন। তাদের দুই ভাইয়ের অবৈধ সব সম্পদ জব্দ করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।’

সোমবার (১৪ অক্টোবর) সকালে সালথা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাজেদা চৌধুরীর দুই ছেলে সালথা ও নগরকান্দাকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। মামা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর এমন কোনো অত্যাচার নেই যা তারা দুই ভাই করেনি। আমার বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত ২৯টি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমি আজকেও হাজিরা দিতে কোর্টে এসেছি। তারা দুই ভাই এ আসনে জনগণের জন্য রাজনীতি করতে আসেননি। তারা এসেছিলেন মায়ের ক্ষমতা খাটিয়ে লুটপাট করতে। তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে শতশত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। সালথা-নগরকান্দার মাটিতে তাদের দুই ভাইয়ের জায়গা আর হবে না। এ আসনে বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকুর ঘাটি। এখানে কোনো সন্ত্রাস চাঁদাবাজের আর স্থান হবে না।’  

এ সব অভিযোগের বিষয় বক্তব্য নেওয়ার জন্য সাজেদা চৌধুরী বড় ছেলে আয়মন আকবর বাবলু চৌধুরী ও শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। এমনকি তাদের ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।

 

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর