শিল্প প্লটে বাড়ি তৈরির নিয়ম না থাকলেও দলীয় প্রভাবে সিটি করপোরেশন বা রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি। আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত বাড়িটিতে সুইমিং পুল ও হেলিপ্যাডসহ নানা সুবিধা রয়েছে। বাড়ি ছাড়াও নদের জমি ভরাট করে কারখানা ও গোডাউন নির্মাণ করেছেন ওই আওয়ামী লীগ নেত্রী। গোডাউন ভাড়া দিয়ে বছরে আয় করছেন কোটি কোটি টাকা।
গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরসংলগ্ন জমি দখল করে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি নির্মাণ করেছেন আওয়ামী লীগ নেত্রী আফরোজা বারী। বাড়ির নাম ‘বুলবুল’। আফরোজা বারী আনন্দ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। একই সঙ্গে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
স্থানীয় লোকজনের তথ্য মতে, তুরাগ নদের কামারপাড়া ব্রিজসংলগ্ন টঙ্গী শিল্প এলাকার ওই জমিটি ছিল বিটিএমসির অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের জেটি। এই জেটি দিয়ে মিলের কাঁচামাল তুলা এবং তৈরি করা সুতা ও কাপড় নৌযানে ওঠানো-নামানো হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০০ সালের শেষদিকে মিলটি পানির দরে টঙ্গীর শ্রমিক লীগ নেতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২০০৫ সালে শিল্প-কারখানা স্থাপনের শর্তে বিটিএমসি থেকে মিলের পাশের ৯ একর (২৭ বিঘা) জমি অনেক কম দামে কিনে নেয় আনন্দ গ্রুপ। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই জমিসহ নদের তীরসংলগ্ন আরো তিন-চার একর জমি ভরাট করে বাগানবাড়ি, কারখানা ও গোডাউন তৈরি করেন আফরোজা বারী।
টঙ্গীতে তিনি নিজেকে ‘শেখ হাসিনার বান্ধবী’ বলে পরিচয় দিতেন। এ কারণে নদের জমি দখলের সময় কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পায়নি। পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত নদের সীমানা নির্ধারণ করে পিলার স্থাপন এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। দখলদারদের ওই তালিকায় আনন্দ গ্রুপের নাম থাকায় ২০২১ সালে কারখানা ও গোডাউনের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দিলেও নদের জমি এখনো আনন্দ গ্রুপের অধীনেই রয়েছে।
পাশে থাকা বাগানবাড়িতে নদের জায়গা থাকলেও আফরোজা বারীর বাধায় উচ্ছেদ চালায়নি বিআইডব্লিউটিএ। স্থানীয় মাছিমপুর এলাকার বাসিন্দা মো. এরশাদউল্লাহ বলেন, দখল বন্ধে বিআইডব্লিউটিএ নদের সীমানা ঘেঁষে ওয়াকওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তবে আফরোজা বারীর দখলে থাকা নদের জমি উদ্ধার না করেই ওয়াকওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য টঙ্গী নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক শাহ আলম মিয়া সাবেক এমপি আফরোজা বারীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে শুনেছি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নেত্রীর ওই বাড়িটির সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশেই ৬ নম্বর পিলারসংলগ্ন আনন্দ গ্রুপের অপর প্রতিষ্ঠান জেরিনা কস্পোজিট টেক্সটাইল ও গোডাউনের দখলে থাকা সাত-আট বিঘা জমি বাইরে রেখে তৈরি করা হচ্ছে ওয়াকওয়ে। সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি তৈরি করতে সিটি বা রাজউকের কাছ থেকে নকশা অনুমোদন বাধ্যতামূলক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদন ছাড়াই বাড়ি নির্মাণ করেছেন ওই আওয়ামী লীগ নেত্রী।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনির হোসেন জানান, ২০১৩ সালের বাংলাদেশ পানি আইন ও বন্দর আইন ১৯০৮ অনুয়ায়ী নদীবন্দর এলাকায় নদীর তীর থেকে ১৫০ ফুট দূরত্বের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ অবৈধ। আনন্দ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাড়ি, কারখানা ও গোডাউনের পাশে সীমানাপিলার ও ওয়াকওয়ের মাঝখানে কোথাও ১৩ ফুট, কোথাও ১৮ বা ৩০-৩৫ ফুট খালি রেখে নদীর তীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। নদীর জমি ছেড়ে দিয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ মানে দখলদারকে বৈধতা দেওয়া, যা নদী রক্ষার অন্তরায়। অবিলম্বে নদীর জমি উদ্ধার করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা প্রয়োজন।
আফরোজা বারীর ওই বাগানবাড়ির ভেতর নদের জমি রয়েছে বলে স্বীকার করে টঙ্গী নদীবন্দরের সহকারী পরিচালক শাহ আলম মিয়া জানান, বাড়ির ভেতরে দুটি সীমানাপিলার বসানোর কথা ছিল। আফরোজা বারীর প্রভাবের কারণে এত দিন পিলার বসানো সম্ভব হয়নি। একটি পিলার বাড়ির সীমানাপ্রাচীর থেকে ১৩ ফুট ও অন্যটি ১৮ ফুট ভেতরে বসানোর কথা ছিল।
নদীর জমি উদ্ধার না করে এবং জমি ছেড়ে দিয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং নদীবন্দর ও পানি আইন ভেঙে ১৫০ ফুটের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে পত্রিকায় কিছু না লেখার অনুরোধ করেন। আফরোজা বারীর কাছে থেকে টাকা নেওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করেছেন।
৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে আফরোজা বারী পলাতক। বাগানবাড়ির বিষয়ে জানতে তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
মন্তব্য করুন: