চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যে চীন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। দেশটি তাদের 'মেংঝৌ' নামে পরিচিত মানববাহী নভোযানের জরুরি অবতরণ বা 'এস্কেপ ফ্লাইট টেস্ট' সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। মান্দারিন ভাষায় 'মেংঝৌ' অর্থ 'স্বপ্নের জাহাজ'।
২০২৭ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে চীন তিনজন নভোচারীকে চাঁদের মাটিতে নামানোর পরিকল্পনা করেছে। এ লক্ষ্যে গত ১৭ জুন মেংঝৌ নভোযানের জরুরি অবতরণের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চালানো হয়। চীনের মহাকাশ সংস্থা সিএমএসএ জানিয়েছে, এটি গত ২৭ বছরে দ্বিতীয়বারের মতো চালানো 'জিরো অল্টিচিউড' বা ভূমি থেকে সম্পন্ন হওয়া— এই ধরনের পরীক্ষা। এর আগে ১৯৯৮ সালে শেনঝৌ নভোযানে এ পরীক্ষা হয়েছিল।
মেংঝৌ নভোযানের সঙ্গে একটি 'লঞ্চ এস্কেপ টাওয়ার' সংযুক্ত করা হয়েছে, যা কঠিন জ্বালানিচালিত শক্তিশালী রকেট মোটরের সাহায্যে কাজ করে। উৎক্ষেপণের সময় কোনো বিপদ বা প্রযুক্তিগত সমস্যা ধরা পড়লে—মাত্র দুই সেকেন্ডের মধ্যে নভোযানের ক্যাপসুলকে রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে, নিরাপদে অবতরণ নিশ্চিত করতে পারে এ ব্যবস্থা।
চীনা মহাকাশ সংস্থাটি জানিয়েছে, আগের শেনঝৌ নভোযানে এস্কেপ ব্যবস্থা মূলত রকেটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এবার মেংঝৌ'র ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণভাবে নভোযানের ভেতরেই সংহত করা হয়েছে। ফলে নিরাপত্তার মান আরও উন্নত হয়েছে।
লং মার্চ ১০-এর প্রস্তুতি এগিয়ে
চাঁদে মানুষ পাঠাতে চীনের প্রয়োজন আরও শক্তিশালী রকেট। বর্তমানে ব্যবহৃত 'লং মার্চ ৫' রকেট ২৫ টন পর্যন্ত উপকরণ পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে বহনে সক্ষম হলেও, কিন্তু মানব নভোচারীসহ চাঁদে পৌঁছানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।
এজন্যই তৈরি করা হচ্ছে উন্নততর 'লং মার্চ ১০' রকেট, যার প্রথম সংস্করণ 'লং মার্চ ১০এ' – ২০২৬ সালে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে। এই রকেটের দুটি বুস্টার বাদ দেওয়া হয়েছে, এবং এটি ১৪ টন ওজনের নভোযান বা সাতজন পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে নিম্ন-কক্ষপথে যেতে পারবে। এটি আংশিক পুনঃব্যবহারযোগ্যও।
পূর্ণাঙ্গ 'লং মার্চ ১০' রকেট ৭০ টন পর্যন্ত বহন করতে পারবে নিম্ন-কক্ষপথে, এবং ২৭ টন পর্যন্ত চাঁদের কক্ষপথে বা ট্রান্স-লুনার ইনজেকশন কক্ষপথে।
২০২৭ থেকে শুরু তিন ধাপের চন্দ্র মিশন
চীনের মহাকাশ অভিযা কর্তৃপক্ষ— চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিএনএসএ) এর অনুযায়ী, ২০২৭ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে তিনবার 'লং মার্চ ১০' উৎক্ষেপণ করা হবে। এরপর ২০৩০ সালে চাঁদের অবতরণযান 'লানইয়ু' এবং মানববাহী নভোযান 'মেংঝৌ' পৃথকভাবে উৎক্ষেপণ করা হবে। চাঁদের কক্ষপথে গিয়ে এ দুটি যানের ডকিং বা সংযোগ সম্পন্ন হবে, এরপর তিনজন নভোচারী চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবেন।
'চাঁদ হবে আমাদের উঠোন'
চীনের মহাকাশ বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কেবল চাঁদে অবতরণই নয়, চীন চাঁদে স্থায়ীভাবে মানুষের বসবাস নিশ্চিত করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে।
চীনের সিচুয়ান প্রদেশের এক বিশ্লেষক সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে লিখেছেন, "আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য চাঁদকে চীনের উঠোনে পরিণত করা। সেখানে মানুষ ঘরবাড়ি বানাবে, অবাধে যাতায়াত করবে, এমনকি বিনোদনও উপভোগ করবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা চাঁদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে পানি আহরণ ও অক্সিজেন উৎপাদনের প্রযুক্তি উন্নত করব। একই সঙ্গে অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও মহাকাশ প্রযুক্তি ভাগাভাগি করব এবং তাদের নভোচারীকেও চাঁদে পাঠানোর সুযোগ করে দেব।"
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার তুলনায় চীন এগিয়ে?
১৯৭২ সালে 'অ্যাপোলো ১৭' মিশনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ মানুষকে চাঁদে পাঠায়। পরবর্তী 'আর্তেমিস-৩' মিশনে ২০২৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চারজন নভোচারী চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি থাকবেন, যারা অভিযানটি সফল হলে চাঁদের ওই অঞ্চলে পা রাখবেন।
চীনা বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বিলম্বিত হলেও—চীনের চন্দ্র অভিযানের প্রস্তুতি দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। ফলে নতুন মহাকাশ প্রতিযোগিতায় চীন এগিয়ে যেতে পারে বলেও তারা মনে করছেন।
সোর্স: The Business Standard
মন্তব্য করুন: