বর্তমান নিবন্ধে দুটি প্রজন্ম নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমটি জেন জেড বা জেনারেশন জেড, যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এবং যারা তাদের বেশিরভাগ কাজের জন্য ডিজিটাল মাধ্যম কেউ বেছে নেয়। দ্বিতীয়টি হলো মিলেনিয়াল জেনারেশন, যাদের জন্ম ১৯৮০ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে, যে প্রজন্ম ইন্টারনেটের ঊষালগ্নে বড় হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষীও।
জেন জেড হলো ডিজিটাল যুগের প্রথম প্রজন্ম, যারা কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল পরিবেশে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এবং আগামী দিনে ডিজিটাল পরিকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী। এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ জেন জেড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই, আমরা এই প্রজন্মকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করতে পারি, তাহলে তারা জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে নিজেদের পাশাপাশি গড়ে তুলতে পারবে আমাদের সমাজকেও। একই সঙ্গে তারা বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
এই দুটি জেনারেশনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে প্রোগ্রামিং দক্ষতা। তাদের দক্ষতা হতে পারে একটি বা একাধিক প্রোগ্রামিং ভাষার ওপর ভিত্তি করে। যেমন-পাইথন আরসি++ এবং জাভাক্রিপ্টের মতো প্রোগ্রামিং প্ল্যাটফরমে। সবগুলো প্রোগ্রামিং ভাষা যে একজনকেই শিখতে হবে, এমনটা কথা নেই। বরং, যে কেউ শুধু একটি ভাষার ওপর জোর দিয়ে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্ঞানচর্চা এবং বিভিন্ন ফাংশনের সৃষ্টি ও প্রয়োগ সম্পর্কিত জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে।
এই প্রোগ্রামিং ভাষাগুলো সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রাম লিখতে, টেস্ট করতে এবং তার প্রয়োগে ব্যবহৃত হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রোগ্রামিং ভাষাগুলোর পাশাপাশি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগোরিদম ও মডেলগুলো তৈরি এবং ব্যাখ্যা করার জন্য বীজগণিত, ক্যালকুলাস, সম্ভাব্য এবং পরিসংখ্যান সম্পর্কিত পর্যাপ্ত জ্ঞানও প্রয়োজন। তার সঙ্গে সুপারভাইজড লার্নিং, আনসুপারভাইজড লার্নিং, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং এবং নিউরাল নেটওয়ার্ক বোঝা ও সর্বোচ্চ জ্ঞান রাখার অভ্যাস ও ধারণাগুলো আয়ত্ত করা অপরিহার্য।
ওপরের এই দক্ষতাগুলো ছাড়াও তরুণ প্রজন্মের ডাটা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান থাকা জরুরি। এ সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই পৃথিবী বিগ ডাটার ওপরে ভর করে আছে এবং আমাদের ব্যবসার জগৎ দিন দিন কৃত্রিম বুদ্ধিমতানির্ভরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই ধাবিত হওয়া ঘটছে দ্রুত গতিতে এবং ঘটছে ডাটা সায়েন্স এবং বিগ ডাটার জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। এ জন্য আমি মনে করি ডাটা সায়েন্সের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বিগ ডাটা কি তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা বিগ ডাটাকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ব্যাখা করেছেন। বিগ ডাটাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ইংরেজিতে ছয়টি ভি ব্যবহার করে থাকেন। সেগুলো হলো-ভলিউম (পরিমাণ), ভ্যারাইটি (বৈচিত্র্য), ভেলোসিটি (গতিশীলতা), ভ্যারিয়েবিলিটি (পরিবর্তনশীলতা), ভেরাসিটি (সত্যতা) এবং ভ্যালু (মান)।
আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বিগ ডাটার দক্ষতা এবং জ্ঞান তরুণ প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ অনেক আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় প্রতিষ্ঠানে ডাটা এবং প্রক্রিয়াকরণ স্থানান্তর বা ডাটা মাইগ্রেশনের মাধ্যমে তাদের সিস্টেমস পুনর্গঠন করবে। তাই তাদের এ ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং সক্ষমতার প্রয়োজন।
এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিদ্যমান সিস্টেমগুলোকে আরো স্মার্ট এবং স্বায়ত্তশাসিত করার জন্য বা মানুষের হস্তক্ষেপ কমানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে পরোক্ষ ইনজেকশন প্রোগ্রাম এবং প্লাগ-ইন ফাংশনের প্রয়োজন হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন স্কিলস যেমন ডাটা সংগ্রহ পরিষ্কার (ক্লিনিং/ প্রি-প্রসেসিং) এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মতো টুলস ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত সিস্টেমগুলো তৈরি করতে বিগ ডাটা ব্যবহার করে ট্রেনিং এবং টেস্টিং করা অপরিহার্য, যেটা কি না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ডেভেলপ করার পূর্বশর্ত। সেই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল ডেভেলপ করতে সব সময় বা যখন যেই প্ল্যাটফরম দরকার, তাতে দক্ষতা থাকতে হবে। যেমন : জুপিটার নোটবুক, টেনসরফ্লো, পাইটর্চ, এবং স্কিট-লার্নের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ফ্রেমওয়ার্কের সঙ্গে পরিচয় থাকতে হবে।
তরুণ প্রজন্মকে বিশ্বব্যাপী ব্যবসাশিল্প জুড়ে বাস্তব সমস্যাগুলোর জন্য উপযোগী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সমাধান ডিজাইন করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ শুরু করার আগে এই প্রজন্মকে দায়িত্বশীলভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নৈতিকতা, পক্ষপাতিত্ব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান থাকা জরুরি। নতুনদের জন্য জটিল ধারণাগুলোকে সহজ-সরল করে ব্যাখ্যা করতে হবে, যাতে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাপ্লিকেশনগুলো সুন্দর করে বুঝতে, তৈরি করতে এবং ব্যবহার করতে পারে।
শিক্ষানবিশ হিসেবে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক খাতে প্রয়োগ করার মতো অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের বাস্তব জ্ঞান এবং সহযোগিতার জন্য শিল্প ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার সম্মক জ্ঞান লাভ করা জরুরি।
ত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে সংযুক্ত করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাধারণ ব্যবহারগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া যেতে পারে। এই প্রযুক্তি কীভাবে ট্র্যাডিশনাল আইসিটিকে মানুষের অনুকরণীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় এবং কেন তা প্রয়োজনীয়, এর ভালো-মন্দ দিকগুলো কী কী, কীভাবে এই প্রযুক্তি সমাজের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায় বা যেতে পারে, সে সম্পর্কে খুদে শিক্ষার্থীদের কিছুটা ধারণা দিতে হবে।
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত নৈতিকতা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ছোট পরিসরে কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত অ্যাপ্লিকেশন তৈরি এবং প্রয়োগের জ্ঞান লাভ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রজেক্টগুলো স্কুলের আইসিটি শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়ার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এ ছাড়া শিক্ষা দেওয়ার সহযোগিতার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে রোবটের প্রয়োগ উন্নত দেশগুলোয় বহুল প্রচলিত। যেমন : কোনো শিশুই যাতে পিছিয়ে না থাকে, সেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত রোবট শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত শেখার গতি এবং শৈলীর সঙ্গে পাঠগুলোকে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে। ইন্টারেক্টিভ লার্নিং টুলস বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গেম এবং অ্যাপগুলো গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষার মতো বিষয়গুলো আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত অনুবাদ এবং ভয়েস রিকগনিশন টুলস শিক্ষার্থীদের ইংরেজির পাশাপাশি তাদের মাতৃভাষায় শিখতে সাহায্য করতে পারে।
দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণা কেন্দ্র চালু করা খুবই জরুরি। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে এই প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য বড় ধরনের ফান্ড তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পাঠগুলো সংযোজন করতে হবে। দেশ-বিদেশে অবস্থিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক শিক্ষক এবং গবেষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা সহায়তা যেমন বিভিন্ন ডাটা বিশ্লেষণ, নমুনা পর্যালোচনা এবং উদ্ভাবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষণার গতি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য ল্যাব পরীক্ষাগুলো অনুকরণ করতে পারে, যা ব্যয়বহুল অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করবে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত সিস্টেমগুলো শিক্ষার্থীদের দক্ষতা এবং আগ্রহ বিশ্লেষণ করে ক্যারিয়ারের পথ এবং উপযুক্ত একাডেমিক প্রোগ্রামগুলো সুপারিশ করতে পারে। ই-লার্নিং প্ল্যাটফরমগুলো অভিযোজিত কনটেন্ট ডেলিভারি, স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন এবং রিয়েল-টাইম প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষাকে উন্নত করতে পারে।
বর্তমানে, বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি মানুষের জ্ঞান অন্বেষণের আগ্রহ বাড়ছে। যার ফলে স্বল্প পরিসরে সরকারি সহযোগিতায় কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোর্স চালু করা এখন সময়ের দাবি। এই কোর্সগুলো হতে পারে পাইথন, মেশিন লার্নিং, কম্পিউটার ভিশন, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (এনএলপি) এবং জেনারেটিভ এআই জেন এআইয়ের মতো বিষয়গুলোর ওপর। আমি মনে করি, আজকের এই আলোচনা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রে তরুণ সমাজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জ্ঞানকে সংহত করার এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা জোগাবে।
লেখক : প্রফেসর অব বিজনেস অ্যানালিটিকস
উপপরিচালক, সেন্টার ফর অ্যাপ্লাইড অ্যান্ড রেস্পন্সিবল এআই
নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া
সোর্স: আমার দেশ
মন্তব্য করুন: