শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে বসানো হয়েছে মানহীন যন্ত্রপাতি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে অযৌক্তিক কাজ করা হয়েছে। সাত হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে ২২ হাজার কোটিতে। একইভাবে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর এবং কক্সবাজারে বিমানবন্দর উন্নয়নের নামে হয়েছে লুটপাট।
বিগত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে উন্নয়ন কাজের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ আটজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান করবে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। ইতিমধ্যে অভিযোগ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে। দুদকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অভিযোগ অনুসন্ধানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দরপত্রে ইউরোপীয় মানের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামাদির উল্লেখ থাকলেও চীন ও কোরিয়ার নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামাদি সংযোজন এবং সিলিংয়ের কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কেনা জিনিসপত্রকে বিদেশ থেকে কেনা দেখানো হয়েছে। মাটি পরীক্ষায় করা হয়েছে অনিয়ম। নকশাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রকল্পের তিনটি বড় কাজ অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, আইন ও বিধি মোতাবেক অভিযোগটির অনুসন্ধান সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা হলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মহিবুল হক, সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, মাহবুব আনাম ও অ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার লুৎফুল্লাহ মাজেদ।
অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। তাকে সহযোগিতা করবেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান, সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, এস. এম. রাশেদুল হাসান, এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর।
শাহজালালের থার্ড টার্মিনাল থেকে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এ প্রকল্প থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এমন অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আক্তার হোসেন বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম মাকসুদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সাত হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত প্রকল্পের ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকায় বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন সরঞ্জামাদি স্থানীয়ভাবে কিনে তা বিদেশ থেকে কেনা দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। মাটি পরীক্ষায় অনিয়ম ও নকশা পরিবর্তন করে ৯০০ কোটি টাকা লোপাট, প্রকল্পের তিনটি বড় কাজ অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
ওসমানী বিমানবন্দরে দুর্নীতির ভূত
সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুই হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন আবদুল জব্বার জলিল কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের সাবেক এই সভাপতি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে এ অভিযোগ করেছেন।
সিলেটের এ ব্যবসায়ী ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তার অভিযোগে বলেন, বিগত সরকারের আমলে দুই হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওসমানী বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও দেশি-বিদেশি ফ্লাইট চালুর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট শুরু হয়। ২০২৩ সালের ২৭ মে’র মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে আরও এক বছর সময় চলে গেলেও মাত্র ২২ শতাংশ কাজ হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, প্রকল্পের টাকা লোপাটের উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জ্ঞাতসারে নকশায় ত্রুটি রেখেছিলেন। ফলে শুরুতেই প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। এতে প্রকল্পে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ আত্মসাতের জন্যই প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, এসব অনিয়মের মধ্যে প্রথমটি হলো প্রকল্প শুরুর আগেই ইক্যুইপমেন্ট মোবিলাইজেশন বাবদ অগ্রিম ২১২ কোটি টাকা নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি)। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা ২২ শতাংশ কাজ করেছে।
আবদুল জব্বার জলিল জানান, এখনো প্রতিষ্ঠানটি ১০০ কোটি টাকার বেশি কাজ করেনি। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো অগ্রিম নেওয়া টাকা খরচের হিসাব দেয়নি।
শাহ মখদুম বিমানবন্দরে অনিয়ম
‘রাজশাহী শাহ মখদুম বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও নবরূপায়ণ’ শীর্ষক প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পে পিডাব্লিউডির ২০১৮ রেট শিডিউল অনুসরণ করা হয়নি।
দুদক সূত্র জানায়, অনিয়মের মাধ্যমে বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করায় কয়েক বছরের মধ্যে প্রাচীরটিই ভেঙে পড়ে। ড্রেন এবং সীমানাপ্রাচীর দুটিতেই নিম্নমানের কাজ হয়েছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে দুর্নীতি
২০১৪-১৫ অর্থবছরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই বছর কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর কেনায় ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
অনিয়মের মাধ্যমে বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করায় কয়েক বছরের মধ্যে প্রাচীরটি ভেঙে পড়ে। ড্রেন ও সীমানাপ্রাচীর দুটিতেই নিম্নমানের কাজ হয়েছে।
এছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দরটির উন্নয়ন প্রকল্পে শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) মো. হাবিবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) মো. হাবিবুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. জহিরুল ইসলাম, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ই/এম) মো. জাকারিয়া হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন রয়েছে।
বিমান বন্দরগুলোর অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা এক কর্মকর্তা বলেন, সেপ্টেম্বর মাসে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে বেবিচক কর্মকর্তাদের একটি তালিকা দুদকে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে কি না, অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত হচ্ছে কি না এবং তদন্ত কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। ওই তালিকায় প্রায় ৪০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামও রয়েছে। দুদক থেকে ওইসব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন নথি ও তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার ও টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর, বিভিন্ন বিমানবন্দরে রাডার মেরামত, কেলিব্রেশন, এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম স্থাপন, বোর্ডিং ব্রিজের স্পেয়ার পার্টস ক্রয়, খান জাহান আলী বিমানবন্দর উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে সংস্কার, প্যারালাল ট্যাক্সিওয়ে, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং বিদ্যমান টার্মিনালের সম্প্রসারণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন-সংক্রান্ত মেগা প্রকল্পে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে একাধিক দপ্তরে।
মন্তব্য করুন: