প্রান্তিক দর্শকের কাছে এক সময় বাংলা নাটক ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিশেষ করে গ্রামীণ দর্শক। সেটা ছিল টেলিভিশনে। তাও আবার বিটিভিতে। এরপর স্যাটেলাইটের কল্যাণে দর্শকরাও ভিন্ন স্বাদের নাটকের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে এ মাধ্যমটির স্থায়িত্বও বেশি বছর হয়নি। নাটকের প্রচারস্থান দখল করে নিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফরম। বর্তমানে নাটক অনলাইনকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ইউটিউব চ্যানেল। দর্শকরাও নিজেদের সময়-সুযোগ মত
প্রান্তিক দর্শকের কাছে এক সময় বাংলা নাটক ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিশেষ করে গ্রামীণ দর্শক। সেটা ছিল টেলিভিশনে। তাও আবার বিটিভিতে। এরপর স্যাটেলাইটের কল্যাণে দর্শকরাও ভিন্ন স্বাদের নাটকের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে এ মাধ্যমটির স্থায়িত্বও বেশি বছর হয়নি। নাটকের প্রচারস্থান দখল করে নিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফরম। বর্তমানে নাটক অনলাইনকেন্দ্রিক, বিশেষ করে ইউটিউব চ্যানেল। দর্শকরাও নিজেদের সময়-সুযোগ মতো পছন্দের নাটক দেখে নিতে পারছেন অনলাইনে। এ কারণে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন নির্মাতা ও কলাকুশলীরা। আর তাতেই প্রাধান্য পাচ্ছে ‘ভিউ’ নামক শব্দ। কারণ, যত ভিউ, তত টাকা। স্বাভাবিকভাবে ভিউকে টার্গেট করেই নির্মিত হয় নাটক। তবে ভিউ যখন লক্ষ্য হয়, তখন নাটক হয়ে যায় ‘কনটেন্ট’। বেশি ভিউয়ের আশায় প্রযোজক, নির্মাতা থেকে শুরু করে শিল্পীরাও এ ভার্চুয়াল লড়াইয়ে মত্ত। ভিউ বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে নাটকগুলোর অদ্ভুত, অশ্লীল, চটকদার ও কুরুচিপূর্ণ নাম। যা আমাদের দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে বিশ্বে অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে তুলে ধরছে। ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে দিন দিন বাংলা নাটকের ঐতিহ্য বিলীনের পথে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
একটা সময় ভালো গল্পের নাটকের সুন্দর নাম দর্শকের মনে দাগ কাটত। নামের অর্থ নিয়ে ভাবতেন তারা। নাম নিয়ে রীতিমতো গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা হতো। এটাই ছিল আমাদের নাটক ও সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য। সেই বিটিভির সময় থেকে আধুনিক যুগের স্যাটেলাইট চ্যানেলেও নাটকের সুন্দর ও অর্থবোধক নাম ব্যবহার করা হতো এবং হচ্ছে। দর্শক এসব নাম দেখে নাটক দেখায় উৎসাহ পেতেন এবং পাচ্ছেন। অথচ এ সময় একটি নাটকের মান নির্ণয় করা হয় ইউটিউব চ্যানেলে কত ভিউ হলো তার ওপর। মানের দিক বিবেচনা না করে, ভিউয়ের ওপর সেটার দর্শকপ্রিয়তা বিচার করা হচ্ছে। ফলে নির্মাতা-শিল্পীরাও ভিউয়ের পেছনে ছুটছেন।
নাট্যবোদ্ধাদের মতে, নাটক কখনো ভিউয়ের বিচারে হয় না। ভিউকে টার্গেট করে যা নির্মিত হচ্ছে, এগুলো নাটক নয়, একেকটা কনটেন্ট। কার কনটেন্ট কত ভিউ হলো, কত টাকা এলো সে হিসাব করে এখন। নাটকের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা ও মান কখনো এক হতে পারে না। বাংলাদেশি নাটকের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। তাই প্রয়োজন আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা। কনটেন্টের এ প্রতিযোগিতায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে আমাদের নাটক।
এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা আবুল হায়াত বললেন, “একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলতেন। টিভি নাটক দেখে বাচ্চারা কথা বলা শিখবে, সে জায়গা থেকে আমরা নাটক করতাম। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। আমরা এখন ভাঁড়ামি গেলাতে চাইছি। জানি না, কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের দায় অনেক। ‘এই শহরে’, ‘আমাদের সমাজবিজ্ঞান’, ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’, ‘মায়া সবার মতো না’, ‘কাঠপেন্সিলের কাহিনী’, ‘তুমি ফিরে আসোনি’, ‘আগন্তুক’, ‘ফেরা’, ‘শুনতে কি পাও’র মতো নামের নাটকও আছে। সেগুলোও দর্শকপ্রিয় নাটক। তবুও এখন ভিউয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি।”
নাটকের নামে কী নির্মিত হচ্ছে, এমন প্রশ্নে প্রখ্যাত অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘ওসব নাটকের একেকটা যখন চোখের সামনে আসে তখন আমার খুব লজ্জা লাগে। ওখানে যেসব দেখানো হচ্ছে সেগুলো কি আমাদের জীবনের গল্প? কীসব তুলে ধরছি আমাদের দর্শকদের কাছে? মানুষের রুচিকে নষ্ট করছি আমরা। যে রকম দেখানো হচ্ছে, দর্শকের রুচি সেভাবেই গড়ে উঠছে। কেমন অশ্লীল কথাবার্তা! কেমন রংঢং! এগুলো কোন সামাজের চিত্র? এগুলো কি বাঙালি সমাজ? এগুলো কি আমাদের ঐতিহ্য? আমাদের সংস্কৃতি? জানি না। আমি এগুলো দেখে বিরক্ত হই।’
নাট্যজন মামুনুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইদানীং বেশির ভাগ নাটকে ভিউয়ের জন্য যে ধরনের নাম দেওয়া হয়, এগুলো অসভ্য লোকের বর্বর কাজ। আমাদের দুঃখ, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। ভিউ বাড়াতে নাটকের নামে কনটেন্ট নির্মাণের যুদ্ধে নেমেছেন সবাই। ভিউ যেন এখন খুব দামি কিছু হয়ে গেছে।’
নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘এখন নাটক চলে গেছে চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ও এজেন্সির হাতে। তারাই নাটকের গল্প ও শিল্পী নির্ধারণ করে দেয়। যার কারণে অনেক সময় নির্মাতারা নিজেদের পছন্দের গল্পে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার এটিও সত্যি, এ সময়ের অনেক তারকা ভালো ভিউ হতে পারে এমন গল্পের নাটকগুলোতেই বেশি কাজ করছেন। যে নাটকের বেশি ভিউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর শিল্পমান কেমন হবে কিংবা দর্শকদের মনে দাগ কাটবে কিনা, তা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।’
জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন সব হচ্ছে ফরমায়েশি নাটক। একটা নাটক দর্শক গ্রহণ করলে চ্যানেলগুলো সে ধরনের নাটকই চায়। নতুন কিছু বানাবে, সে চিন্তা নেই। একটা চরিত্র জনপ্রিয়তা পেলে সেই চরিত্রের রেশ ধরেই নাটক বানাতে হয়। তাহলে নতুন চরিত্র আসবে কী করে? এখন নাটক মানেই কমেডি। এত এত কমেডি করতে গিয়ে সব সস্তা হয়ে গেছে। সস্তা কমেডির ফলে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নাটক থেকে। যারা মনে করেন সিরিয়াস নাটক দর্শক দেখে না তাদের ধারণা যে ভুল, এটা তাদের কে বোঝাবে।’
আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেন, ‘আমরা ভিউয়ের জগতে ঢুকে গেছি, যেটাকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অস্বীকার করার প্রয়োজনও নেই। তবে সেখানে আমার একটা দায়ও আছে। দায় হচ্ছে, আমার একটা নাটক দর্শক দেখবেন, কিন্তু আমার সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়, উলঙ্গ হয়ে নয়। কারণ, আমি তো আসলে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাই। একটা সময় কত সুন্দর সুন্দর নাম আমাদের ছিল। নামের মধ্যে একটা সাহিত্যের ছোঁয়া ছিল। এখন সে জায়গা থেকে আমরা খুব সহজ জায়গায় চলে এসেছি। মানুষের খুব কাছে চলে এসেছি, সাহিত্য থেকে নেমে এসেছি। এটা কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে।’
মন্তব্য করুন: