ajbarta24@gmail.com সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
৮ পৌষ ১৪৩১

৬০ বছরে বাংলাদেশ টেলিভিশন : প্রসঙ্গ জনপ্রিয়তা

ফিচার ডেস্ক

প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১২ এএম
আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ ৫:৫৫ পিএম

ফাইল ছবি

কোনো বিশেষ দিন ছাড়া এখন আর কেউ বিটিভির অনুষ্ঠান দেখে না। একমাত্র সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এই করুণ দশা দেখে অনেক প্রবীণ নাগরিক দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই পারেন। কারণ এক সময় বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেই তারা বড় হয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, সাধারণত বিটিভি নামে পরিচিত; রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সংস্থা। পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ২৭ নভেম্বর লাহোরে প্রথম টেলিভিশন সেন্টারের উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় টেলিভি

কোনো বিশেষ দিন ছাড়া এখন আর কেউ বিটিভির অনুষ্ঠান দেখে না। একমাত্র সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এই করুণ দশা দেখে অনেক প্রবীণ নাগরিক দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই পারেন। কারণ এক সময় বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেই তারা বড় হয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, সাধারণত বিটিভি নামে পরিচিত; রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সংস্থা। পাকিস্তান আমলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ২৭ নভেম্বর লাহোরে প্রথম টেলিভিশন সেন্টারের উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় টেলিভিশন সেন্টারটি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানে, ঢাকার ডিআইটি ভবনে (বর্তমান রাজউক ভবন)। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের ঢাকা কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র বাংলাদেশ টেলিভিশন নামে পরিবর্তন হয়। ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালে নেটওয়ার্কটির প্রথম উপকেন্দ্র নাটোরে উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭৫ সালে এটির দপ্তর এবং স্টুডিও ঢাকার রামপুরায় নতুনভাবে নির্মিত সদর দপ্তরে স্থানান্তর করা হয়।

১৯৮০ সাল থেকে এক দশকে বিটিভি অনেকগুলো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান তৈরি করে। যেমন- 'এইসব দিনরাত্রি,' 'বহুব্রীহি', 'অয়োময়', 'ইত্যাদি', 'কোথাও কেউ নেই', 'আজ রবিবার'। 'আলিফ লায়লা' এবং 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান'-এর মতো বিদেশি অনুষ্ঠানও প্রচারিত হতো, এমনকি অনেক জনপ্রিয় কার্টুনও দেখানো হতো, যেগুলো নেটওয়ার্কের সাফল্যে সাহায্য করেছে। দীর্ঘ আড়াই দশক বিটিভি বাংলাদেশের একমাত্র টেলিভিশন সম্প্রচারক ছিল। ১৯৮০ সালে বিটিভি রঙিন সম্প্রচার শুরু করে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম আনুষ্ঠানিক পূর্ণকাল রঙিন টেলিভিশন সম্প্রচার। ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিটিভি ১৪টি উপকেন্দ্র স্থাপন করে, যেগুলো দেশের ৯৩ শতাংশ এলাকায় পৌঁছে যায়। ১৯৭৭ সালে ফজলে লোহানী বিবিসির দ্য ডেভিড ফ্রস্ট শো-এর ওপর ভিত্তি করে বিটিভির জন্য একটি নতুন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান তৈরি করেন, 'যদি কিছু মনে না করেন'। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।

বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় মেগাসিরিয়াল ছিল সম্ভবত: 'আলিফ লায়লা'। শহরের কথা বলতে পারব না, তবে গ্রামের মানুষ 'আলিফ লায়লা'র খুব ভক্ত ছিল। অনেক গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, টিভি চালানো হতো ব্যাটারি দিয়ে। শুক্রবার এলেই টেলিভিশন ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ, বিকালে বাংলা ছায়াছবি এবং রাতে 'আলিফ লায়লা'-এই বিষয়টি অন্য রকম একটি উপভোগ্য বিনোদন। যাদের বাড়িতে টিভি ছিল, তাদের বাড়িতে রাত ৮টা থেকেই লোকজন আসতে শুরু করত। সাধারণত টিভি-মালিকরা এই রাতে টিভিটি বাইরে সেট করতেন, যাতে সবাই একসঙ্গে দেখতে পারে। মানুষ সারা দিনের ক্লান্তি থেকে ফিরে আনন্দ উপভোগের মাধ্যম হিসেবে এই বিটিভির সামনেই বসত। আর বসবেই না বা কেন? সেই সময়ে যে নাটক বা বিদেশি সিরিয়াল হতো, সেগুলো ছিল সত্যিই বিনোদন, উপভোগ্য।

'কোথাও কেউ নেই' নাটকের কথা কি সেই সময়ের দর্শকরা ভুলতে পেরেছেন? নাটকটির নাট্যকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। প্রযোজনা করেছিলেন বরকত উল্লাহ। ১৯৯৭ সালে স্যাটেলাইট টেলিভিশনে এটিএন বাংলা এবং ২০০০ সালে টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশনে একুশে টেলিভিশনের উদ্বোধনের পর বিটিভির দর্শক কমতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্ধশতাধিক টিভি চ্যানেলের বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান ও নানা সংবাদ প্রচারের ফলে বিটিভি হারিয়ে যেতে বসেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সেক্টরের মতো নিয়ম মেনে খোলস বদলেছে বাংলাদেশ টেলিভিশনও (বিটিভি)। কতটা বদলাল, সেটিই এখন আলোচনার বিষয়। প্রচারিত হচ্ছে আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের বিষাদময় স্মৃতি, যা দেখে দর্শক-শ্রোতা অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে চ্যানেলটির প্রশাসনিক পর্যায়ে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক কাণ্ড ঘটেছে বার্তা বিভাগে, জেলা সংবাদ প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে। দেশের ৬৪ জেলার সব সংবাদদাতার নিয়োগ এক সঙ্গে বাতিল করা হয়েছে। অতীতে বিটিভির জেলা প্রতিনিধিদের নিয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐ জেলার মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশে হয়েছে। কিন্তু সবাই দলীয় কর্মকাণ্ডে ছিলেন না। এই বিষয়টি কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অভিযোগের ভিত্তিতে বাতিল করলে ভালো হতো। এমন অনেকে ছিলেন, যাদের আগে অন্যায়ভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। একটি জেলার বিটিভি প্রতিনিধির সম্মানি হয়তো তেমন বেশি নয়, কিন্তু তার মান মর্যাদাকে তাচ্ছিল্য করা যায় না। যাই হোক, নতুন করে জেলা প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। কিন্তু বরখাস্তকৃত জেলা প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট করা হলে মহামান্য হাইকোর্ট নিয়োগ বাতিলের আদেশ স্থগিত করে বিটিভি কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। সেই থেকে বিটিভিতে জেলাসমূহের সংবাদ প্রচার বন্ধ রয়েছে।

মানুষ এখন আর উন্নয়ন নিয়ে সরকারের সাফল্যের ফাঁকা বুলি শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায়, দেশ পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রসংস্কারে সরকার কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর ভূমিকা কেমন। বিশেষ করে পুলিশ তার দায়িত্ব কীভাবে পালন করছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর সরকার ও গণমাধ্যমের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। চাঁদাবাজি, দখলদারি, অনিয়ম, দুর্নীতি বিষয়ে মানুষ জানতে চায়। দ্রব্যমূল্য হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধ দমনে আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে সরকারের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড গণমাধ্যমে দেখতে চায়। এ জন্য বিটিভির অনুষ্ঠান, বিশেষ করে খবর প্রচারে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি খবরের পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির খবরও প্রচার করতে হবে। অপরাধী চিহ্নিত ও আটকের জন্য সরকারের পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এবং আর্থিক অনিয়ম তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করছে, তাহলে ঐ সব বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমস্যা-সংকটের খবর কেন বিটিভিতে প্রচার করা যাবে না? করা যাবে না, কারণ বাংলাদেশ টেলিভিশন এখনো আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ। জনবলের আধিক্যে ভারাক্রান্ত। বিশেষ করে বার্তা বিভাগে। তাদের মধ্যে কি সৃজনশীলতার অভাব, না কি কোথাও প্রতিবন্ধকতা ছিল?

গত ৩ সেপ্টেম্বর নতুন করে বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছেন দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকরা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দৈনিক পত্রিকার মোট ২০ জন সম্পাদক এই দাবি জানান। এটি জনগণেরই দাবি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। আশা করি, অচিরেই তিনি এই দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন।

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর