স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর সব ধর্ম-দর্শনে স্বাধীনতার অশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষ্যে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করাই ইসলামের নির্দেশ।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ইমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। একিইভাবে বিজয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা কর। আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল।’ (সূরা নসর, আয়াত : ১-৩)।
বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিজয় দিবস উদযাপন করেছিলেন। যে মক্কা নগরী থেকে আল্লাহর নবি বিতাড়িত হয়েছিলেন আর হিজরতের সময় বারবার অশ্রুসিক্ত নয়নে জন্মভূমির দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়েছিলেন আর বলেছিলেন-‘হে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার অধিবাসীরা যদি আমাকে অত্যাচার-নির্যাতন করে বিতাড়িত না করত; আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যেতাম না।’ মহানবঅ (সা.)-এর বুকফাটা আর্তনাদের অবসান হয়েছিল ১০ হিজরির মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। ১০ বছর পর শতসহস্র সাহাবায়ে কেরামের বিশাল বহর নিয়ে যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি শুকরিয়া স্বরূপ আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। বিশ্বনবী (সা.) বিজয়ের আনন্দে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে কৃতজ্ঞতা আদায়ে এভাবে নফল নামাজ পড়লেন। নবিজি (সা.)-এর দেখাদেখি অনেক সাহাবি (রা.) মহানবির অনুকরণে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।
এরপর বিশ্বনবীর (সা.) হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশে বয়ান প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! ১৩ বছর আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবাদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছ, এর বিপরীতে আজকে তোমাদের কী মনে হয়, তোমাদের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করব?’ তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান, আমাদের সঙ্গে উদারতা, মহানুভবতা প্রদর্শন করবেন। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তখন আল্লাহর নবি মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও তোমাদের প্রতি আজ কোনো অভিযোগ নেই। তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।’ (সুনানে বাইহাকি)। তাই তো মক্কা বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন
মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের একটি ঘটনাও ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। আবু সুফিয়ানকে যখন গ্রেফতার করে রাসূল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত করা হয়, তখন তিনি তাকে বলেন, বল কী চাও? সে বলে, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি আপনার জাতির প্রতি দয়া করবেন না। আপনি তো পরম দয়ালু ও মহানুভব; এছাড়া আমি আপনার আত্মীয়ও বটে, ভাই হই; তাই আমাকে সম্মান দেখানও প্রয়োজন। কেননা, এখন আমি মুসলমান হয়ে গেছি। রাসূল (সা.) বলেন, ঠিক আছে যাও মক্কাতে ঘোষণা করে দাও; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আবু সুফিয়ান বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আমার ঘরে আর কতজনের সংকুলান হবে। এত বড় শহর; তা আমার ঘরে আর কতজন আশ্রয় নিতে পারবে। রাসূল (সা.) বলেন, ঠিক আছে যে ব্যক্তি কাবা শরিফে আশ্রয় নেবে তাকেও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আবু সুফিয়ান বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কাবা শরিফও ছোট্ট একটি জায়গা সেখানেইবা কতজন আশ্রয় নেবে তারপরও লোক বাকি থেকে যাবে।
তখন রাসূল (সা.) বলেন, যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, তাকেও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এবার আবু সুফিয়ান বললেন-হে আল্লাহর রাসূল! যারা রাস্তাঘাটে বসবাস করে তারা কোথায় যাবে? তারপর তিনি একটি পতাকা বানান এবং বলেন, এটি বেলাল (রা.)-এর পতাকা। তাকে সঙ্গে নিয়ে এ পতাকাসহ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা কর, যে এ পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে, পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে তাকেও প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে। আবু সুফিয়ান বললেন, ঠিক আছে এবার যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে গিয়ে ঘোষণা করার অনুমতি দিন। যেহেতু মক্কার কুরাইশ নেতারাই অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তাই ভয় পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না।
আবু সুফিয়ান মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করেন, নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ রাখ আর কেউ বাইরে এসো না। কাবা শরিফে চলে যাও এবং হজরত বেলাল (রা.)-এর পতাকার নিচে যারা আশ্রয় নেবে তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাদের সবার প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে এবং কিছুই বলা হবে না। আর তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ কর। ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং হজরত বেলাল (রা.) পতাকা তলে সমবেত হতে আরম্ভ করে। এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত হজরত বেলাল (রা.)-এর পতাকাতলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের এটিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা যাকে দাস মনে করতে, যার কোনো গোত্র বা আত্মীয়স্বজন মক্কায় ছিল না। তাকে একেবারেই নিঃস্ব এবং পায়ে ঠেলার মতো মানুষ মনে করে তোমরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছ। আজ শোন এবং দেখে নাও! তোমরা শক্তিশালী নও, তোমরা সফলকামী নও, পরাক্রমশালী তোমরা নও বরং মহাপরাক্রমশালী হচ্ছেন রাসূল (সা.)-এর আল্লাহ। আর রাসূল (সা.) প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বৈশিষ্ট্যাবলি অবলম্বন করেছেন এবং এ গুণাবলি ধারণ করেছেন। এভাবে বিজয় লাভের পর প্রতিশোধ না নিয়ে করেছিলেন ক্ষমা। বিজয়ের দিন তার মাঝে ছিল না কোনো অহংকার আর আত্মম্ভরিতা।
তাই আমাদের উচিত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করা। আমরা যদি এমনটি করতে পারি তবেই হবে বিজয়ের মূল সার্থকতা।
মন্তব্য করুন: