গত বেশ কিছুদিন বিশ্বের দুষিত শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান বারবার শর্ষে উঠে আসছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে দুষিত বায়ুর দেশ হিসেবে শীর্ষস্থানে ছিল।
“ঢাকার বাতাসে এত দূষণ কিভাবে হচ্ছে? কেউ কি আদৌ ঢাকার বাতাস বিশ্লেষণ করে দেখে? মনে হয় না শুধুমাত্র ধুলা আর নির্মাণকাজের কারণে এভাবে বাতাস দূষিত হচ্ছে। ঢাকার বাতাসে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নিঃসন্দেহে কিছু বিষাক্ত পদার্থ আছে। এটা হতাশাজনক....।”
পেশায় চিকিৎসক সিদরাত জেবিন (৩০) সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট দেন। এর কয়েক ঘন্টা পর তীব্র শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয় ওই চিকিৎসকের। যদিও তিনি আগে থেকেই শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন।
জেবিনের মৃত্যর দিন ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ২২০, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এর দুদিন পর ১৮ ডিসেম্বর সরকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে নিয়মিত মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পহেলা ডিসেম্বর বায়ুমান ছিল একিউআই ১৮৮ যা অস্বাস্থ্যকর। গত দুই সপ্তাহে গড়ে বায়ুমান ছিল একিউআই ২০০ এর উপরে, সর্বোচ্চ দুষিত বায়ু ছিল ৫ ডিসেম্বরে, সেদিন বায়ুমান ছিল ৩৩৫ যা দুর্যোগপূর্ণ বায়ু হিসেবে পরিচিত।
কাগুজে বিধিমালা, তারও বাস্তবায়ন নেই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বায়ুদুষণ কেন হচ্ছে, কারা দায়ী-এসব নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা যথেষ্ট হয়েছে, আলোচনা-সমালোচনারও কমতি নেই। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
ঢাকার বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডি (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, দূষণ মোকাবেলায় ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট করার কথা ছিল, হঠাৎ করে ২০২২ সালের জুলাইয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা করে। শুধু তাই নয়, ক্লিন এয়ার অ্যাক্টের খসড়ায় যেসব ভালো জিনিস ছিল সেগুলোর অধিকাংশই ওই বিধিমালা থেকে বাদ দেয়া হয়।
“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে মানমাত্রার ক্ষেত্রে কঠোর হচ্ছে সেখানে এই বিধিমালায় শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুষণের মানমাত্রায় নমনীয়তা দেখানো হয়। দুর্বল এই বিধিমালাটিরও বাস্তবায়ন নেই,” বলেন তিনি।
ওই বিধিমালায় কোনও এলাকার বায়ুমান নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে সেটাকে অবক্ষয়িত এলাকা (ডিগ্রেডেড এয়ারশেড) ঘোষণা দিয়ে সেখানে দূষণের সকল উৎস বন্ধ করার কথা। একইসাথে একটি বায়ুমান ব্যবস্থাপনা তৈরি করার কথা থাকলেও সেসবের কোনকিছুই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয় বলে জানান ওই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।
কামরুজ্জামান বলেন, ইট ভাটাগুলোতে তাৎক্ষণিক কিছু অভিযান আর মাঝে মাঝে যানবাহনে কিছু নির্গমন মানমাত্রা চেক করা ছাড়া খুব বেশি কাজ হয়নি। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, নারায়নগঞ্জের কাঁচপুরে যেসব স্টিল রি-রোলিং মিল থেকে দুষণ হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করার পদক্ষেপ নেই।
কোন উৎসে কেমন দুষণ?
পরিবেশ অধিদপ্তর কোন উৎস থেকে কতটা বায়ুদূষণ ঘটে, সেটা সর্বশেষ নিরূপণ করে ২০১৯ সালে। নরওয়েজিয়ান ইনস্টিটিউট ফর এয়ার রিসার্চের ওই গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুদূষণের জন্য যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া ১০ শতাংশের বেশি ও রাস্তার ধুলা প্রায় সাত শতাংশ দায়ী।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে, দেশে পাঁচ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আছে। সম্প্রতি মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সড়ক থেকে তুলে নিতে পরিবহন মালিকদের ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার।
বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইয়াসিন জানান, “পরিবহন মালিকদের সাথে আমাদের বৈঠক হয়েছে, এসব গাড়ি সড়ক থেকে কিভাবে তুলে নেয়া যায় তার একটা রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা চলছে।”
বায়ুদূষণের আরেকটা বড় উৎস ইটভাটা। বাংলাদেশ প্রতিবছর ২৩ বিলিয়ন পিস ইট উৎপাদন করে, যা বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ উৎপাদন।
‘বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস’ শীর্ষক ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেশে আট হাজার ইটভাটা রয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। ওই গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ইটভাটার সংখ্যা পাঁচ শতাংশ করে বৃদ্ধি পায়।
‘টেকসই ইট উৎপাদনে জাতীয় কৌশল’ শীর্ষক এক সমীক্ষা অনুযায়ী ইট উৎপাদনে যে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করা হয় সেটা থেকে শুধুমাত্র ঢাকার চারপাশে থাকা ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় ৫৩ হাজার টন বস্তুকণা-১০ ও ১৭ হাজার টন বস্তুকণা-২.৫ নির্গত হয়।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মোহাম্মদ আবদুল মোতালেব বলেন, ইটভাটার প্রায় ৮৫ শতাংশ জিগজ্যাগ হয়ে গেলেও এর চেয়ে আধুনিক মডেলে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, জিগজ্যাগে পুরানো মডেলের ফিক্সড চিমনি মডেলের চেয়ে কম দূষণ হয়, তবে টানেল পদ্ধতির চেয়ে দূষণ বেশি হয়। দূষণের হার হিসেব করলে জিগজ্যাগের মাঝারি মানের দূষণ ঘটে।
এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ও সড়কের ধূলা থেকে ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে। সেটা মোকাবেলার উপায় নিয়ে গত বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে।
এ বিষয়ে উপ-পরিচালক আবদুল মোতালেব বলেন, “পুরো দেশটাই একরকম ডিগ্রেডেড এয়ারশেডের মত অবস্থায় উপনীত হয়েছে। আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়িয়েছি। বায়ুদূষণ মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্টের পরিমাণও বেড়েছে। বিআরটিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ক্লিন এয়ার প্রজেক্ট নামে একটা প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। করণীয় অনেক কিছুই আছে।”
হাসপাতালে রোগী বাড়ছে
গত বছর (২০২৩) শিকাগো বিশ্ববিদ্যায়ের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে মানুষের গড় আয়ু ৬.৮ বছর করে কমছে।
২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে ২০১৯ সালে ৭৮,১৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। “ব্রিথিং হেভি” শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে ঝুঁকিতে অ্যাজমা ও হাঁপানি রোগীরা।
ঢাকার বক্ষব্যাধী হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, অ্যাজমা ও হাঁপানি রোগীদের জন্য এ সময়টা খুবই কঠিন। শীতকাল আসার সাথে সাথে বেড়েছে শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা।
“আগে নিয়মিত ভর্তি থাকত ৬০ থেকে ৭০ জন, এখন সেটা ১০০ থেকে ১১০ জন। এছাড়াও আউটডোর থেকে প্রতিদিন চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা এখন ৬০০, যা প্রতিদিন বাড়ছে,” জানান তিনি।
সমাধান কী
পুরানো যানবাহন সড়ক থেকে পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কামরুজ্জামান বলেন, “এ খাত থেকে আগে ১০ শতাংশ বায়ুদূষণ হলেও এখন তা ১৫ শতাংশ। আর বায়ুদূষণে ইটভাটার দায় ২৮ শতাংশ। ইটভাটাগুলো যত দ্রুত সম্ভব টানেল পদ্ধতিতে রূপান্তর করতে হবে। ”
তিনি বলেন, নির্মাণ কাজ আর সড়কধূলা এখন দূষণের উৎস হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে। ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে এই দুটি খাত থেকে। প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রকল্পে বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ থাকে। সেই অর্থ ঠিকঠাকমতো ব্যয় হয় না বলেই ধারনা, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে।
কামরুজ্জমান বলেন, বায়ুদূষণের সব উৎস নিয়ে সমন্বতিভাবে কাজ করতে হবে। বর্জ্য পোড়ানো, গৃহস্থালি চুলা আর ট্রান্সবাউন্ডারি দূষণের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। এছাড়াও বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। শিল্পকারখানার বায়ুদূষণ হ্রাসে এয়ার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন এই বিশেষজ্ঞ।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রি রক্ষায় আমরা’ এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, “আমাদের দরকার ছিল একটা নির্মল বায়ু আইন। হয়েছে বিধিমালা, তাও দুর্বল। গত সরকার তার অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন কাজ চলমান রাখতে আইন না করে এই বিধিমালা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারেরও এ বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না।”
শক্ত আইন করা এবং এর কঠোর প্রয়োগ ছাড়া বায়দুষণ সমস্যার সমাধান নেই বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না, বলা যায় তারা গাফিলতি করছে।
“সরকারের উচিত নানা সংস্থা যাতে বায়ুদুষণ রোধে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে সেটার জন্য একটা কম্প্রিহেন্সিভ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক করা, এর পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দুর্বল হলেও যে বিধিমালা আছে, সেটি প্রয়োগে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনশক্তি, লোকবল, লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে,” জানান শরীফ জামিল।
মন্তব্য করুন: