বছরের শুরুতে হাসিনা সরকারের ছক অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহসন সম্পন্ন করা নিয়েই ব্যস্ত ছিল পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঝামাঝিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নির্বিচার গুলি, হত্যা এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনরোষের ভয়ে শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ সদস্যদের বড় অংশ আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় পুলিশ বাহিনীতে ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয় পেশাদার অপরাধীরাও। বাড়তে থাকে চুরি,
বছরের শুরুতে হাসিনা সরকারের ছক অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহসন সম্পন্ন করা নিয়েই ব্যস্ত ছিল পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঝামাঝিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নির্বিচার গুলি, হত্যা এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনরোষের ভয়ে শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ সদস্যদের বড় অংশ আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় পুলিশ বাহিনীতে ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয় পেশাদার অপরাধীরাও। বাড়তে থাকে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ।
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করা হয়েছে। যার ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পুলিশ না থাকায় তিন দিন (৬-৮ আগস্ট) দেশের থানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ৯ আগস্ট থেকে সশস্ত্র বাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় পর্যায়ক্রমে থানাগুলো চালু হতে থাকে। পুলিশি কার্যক্রম স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে লেগে যায় কয়েক মাস।
এ সময়ে সানজিদুল হাসান ইমন ও পিচ্চি হেলালের মতো আলোচিত সন্ত্রাসীরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। দেশে তৎপরতা শুরু করেন তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। সক্রিয় হতে থাকে আরও অনেক পেশাদার অপরাধী। এসব কারণে ৫ আগস্টের পর ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বাড়তে থাকে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও বছরের শেষে এসেও তা পুরোপুরিভাবে কমেনি।
সংঘাত-সহিংসতায় বছর শুরু
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের সাজানো এই নির্বাচন ঘিরেও বেশ কিছু সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রিক ৩৪৫টি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন সাতজন। আহত হন পুলিশের সদস্যসহ সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তি।
ওই নির্বাচনের দুই দিন আগে ৫ জানুয়ারি যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা ট্রেন বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়। এতে দুই নারী, এক শিশুসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। ওই আগুন কারা দিয়েছিল, তা এখনো শনাক্ত হয়নি।
এই বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল কলকাতায় বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য (ঝিনাইদহ-৪) আনোয়ারুল আজীমকে নৃশংসভাবে হত্যা। ১২ মে ভারতে গিয়ে পরদিন রাতে কলকাতার একটি বহুতল আবাসিক ভবনে তাঁকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। পরে কলকাতার দুটি স্থান থেকে কিছু হাড় ও মাংস উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার সাত মাস পর ২০ ডিসেম্বর কলকাতার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আনোয়ারুলের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌসের (ডরিন) ডিএনএ নমুনার সঙ্গে উদ্ধার হওয়া ওই দেহাবশেষের ডিএনএর মিল পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল, দেশে খুনের পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়ন করা হয় কলকাতায়। এই ঘটনায় কলকাতায় এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে আসা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এই ঘটনায় ঢাকায় ও কলকাতার আদালতে একাধিক আসামি জবানবন্দি দিলেও তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
বেইলি রোডে অবহেলার আগুনে ৪৬ মৃত্যু
২০২৪ সালে বড় ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে (সাততলা) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড অন্যতম। এতে নারী, শিশুসহ ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ওই ভবন দীর্ঘদিন ধরেই অগ্নিঝুঁকিতে ছিল। এটাকে নেহাত দুর্ঘটনা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার নির্মম উদাহরণ হিসেবে দেখছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। যদিও ইমারত বিধিমালা ও অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত নির্দেশনা না মানার জন্য তদারক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রামে আইনজীবী খুন
চট্টগ্রামে আইনজীবী ও সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম (৩৫) হত্যার ঘটনা ছিল বছরের আরেক আলোচিত ঘটনা। ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্যসহ আহত হন অন্তত ৩৭ জন। এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে ইসকনকে উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে।
বছরের শেষে সাত খুন, সচিবালয়ে আগুন
বছরের শেষে এসে ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরে সারবাহী জাহাজে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। জাহাজের কর্মীদের ঘুমানোর কক্ষে কক্ষে পড়ে ছিল দেহগুলো। পরে জাহাজের কর্মী আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর র্যাব জানায়, নিয়মিত বেতন-ভাতা ও ছুটি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আকাশ মণ্ডল এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটা দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, সে প্রশ্ন সামনে এলেও তদন্ত শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত সেটা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাবহুল এই বছরের আইনশৃঙ্খলার মূল্যায়ন করতে গিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, আগের সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য তাদের মনোবল দুর্বল হয়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অপরাধীদের কেউ কেউ সুযোগ নিচ্ছে। তিনি বলেন, ক্রাইম ম্যাপিং করে যেই এলাকায় যে ধরনের অপরাধ বেশি, সেই এলাকায় সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা খুবই জরুরি কাজ।
মন্তব্য করুন: