আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মত প্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করার মতো বিধিনিষেধ না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ মাসে স্বাধীনতা উপভোগ করতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন দেশের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।
তাঁদের মতে, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সরকার বারবার আহ্বান জানালেও সাংবাদিকরা নিজেদের রক্ষা করতে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ চর্চা করছেন।
বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলার সাবেক প্রধান বার্তা সম্পাদক জ.ই. মামুন বলেন, “৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দুদিন আগে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে হামলা চালানো হয়। বলা হয়, ওইসব প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনা সরকারের দালালি করছে।”
তিনি বলেন, “সরকার পতনের পর বিরাট সংখ্যক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের সময় সকল সাংবাদিক দালাল ছিল।”
“যারা দালাল ছিল” তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবার আহ্বান জানিয়ে মামুন বলেন, “কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হচ্ছে, ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হচ্ছে, সম্পদের হিসাব চাওয়া হচ্ছে। দালাল হিসাবে ট্যাগ দিয়ে জনসমক্ষে হয়রানি এমনকি চাকুরিচ্যুত করা হচ্ছে।”
“এই প্রেক্ষাপটে, মামলা, হামলা, হয়রানির ভয়ে অনেক সাংবাদিকই কথা বলছেন না, নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন,” বলেন মামুন।
“বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এখন একটি “সংকটময় পরিস্থিতির” মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে মামুন বলেন, “আমার ৩৩ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে কোনো সরকারের আমলে, এমনকি সামরিক সরকারের আমলেও সাংবাদিকদের এমন চাপে থাকতে দেখিনি।”
উল্লেখ্য, গত আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে-পরে গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ হত্যা মামলা দায়ের, জনসমক্ষে হয়রানি, গ্রেপ্তার, আর্থিক হিসাব চেয়ে জনসমক্ষে নাম প্রকাশ, ‘দালাল ও ফ্যাসিবাদের দোসর’ আখ্যা দিয়ে ট্যাগ দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানির বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে।
এসব কারণেই ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বাড়ছে বলে মনে করছেন সাংবাদিক নেতারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি হিসাবে কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। কারাগারে আছেন অন্তত চারজন সাংবাদিক।
এ ছাড়া কয়েক দফায় ১৬৯ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের তালিকা প্রকাশ করেছে তথ্য অধিদপ্তর। যদিও পরবর্তীতে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে সব সাংবাদিকের অ্যাক্রডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়।
সাংবাদিকরা ‘ভয়ের মধ্যে কাজ করছেন’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, “সরাসরি কোনো হস্তক্ষেপ হয়তো নেই। কিন্তু সাংবাদিকরা এক ধরনের ভয়ের মধ্যে কাজ করছেন।”
তিনি বলেন, “এর অন্যতম কারণ মিথ্যা মামলা। আমার বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা মিথ্যা। সাহস করে কেউ কথা বলতে পারছেন না।”
সরকার পতনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ মূল ধারার গণমাধ্যমে এক দল সাংবাদিককে “দালাল, ফ্যাসিবাদের দোসর” ট্যাগ দিয়ে নিষ্ক্রিয় ও “চাকুরিচ্যুত” করে আরেক দল “বিভিন্ন গণমাধ্যমের দায়িত্ব” গ্রহণ করেছেন উল্লেখ করে সোহেল হায়দার বলেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও বিরোধী মতের কিছু সাংবাদিককে সরিয়ে সপক্ষের সাংবাদিকদের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এর ফলে, এক গ্রুপ চুপ। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত গ্রুপ আগের সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালাচ্ছে এবং বর্তমান সরকারকে জিন্দাবাদ বলছে।”
বাংলাদেশে অবস্থান করে বিদেশি সংবাদ সংস্থায় কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ওভারসীস করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ওকাব) সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু মনে করেন শেখ হাসিনা এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার-উভয় আমলেই সঠিক সাংবাদিকতা করার পরিবেশ অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নির্ধারক হলো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং মালিকপক্ষ। মালিকপক্ষ সাংবাদিকতা করতে দেয় না। কারণ তারা মনে করে সরকার যদি মাইন্ড করে!”
“সরকার বলছে আপনারা সমালোচনা করুন। তবে সুস্থ সাংবাদিকতা করার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করছে না। সমালোচনা করলে অফিস, বাসাবাড়িতে আক্রমণ বা প্রকাশ্যে হয়রানি করা হচ্ছে,” বলেন নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “অপ্রিয় হলেও সত্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর সাংবাদিকরা দুই ধারায় বিভক্ত। শেখ হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগ বিরোধী সাংবাদিকরা চাপে থাকতেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ-পন্থী হিসাবে পরিচিত সাংবাদিকরা চাপে পড়েছেন। অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। কেউ কেউ সাইডলাইনে চলে গেছেন। তাঁরা কিছু লিখতে পারছেন না।”
বিএনপি-জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি এম. আব্দুল্লাহ বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কোনো সংস্থা থেকে আদেশ-নির্দেশ জারি করা হচ্ছে না। লেখার কারণে কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে আমি মনে করি না।”
“তবে সেলফ সেন্সরশিপ আছে। নিজের কর্মকাণ্ড এবং দুর্বলতা থেকে অনেকে এই সেলফ সেন্সরশিপ করছেন। তারা মনে করছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তাঁরা বিপদে পড়বেন,” মনে করেন তিনি।
আব্দুল্লাহ বলেন, “যেমন কিছু সাংবাদিকদের আর্থিক হিসাব তলব করে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংক হিসেবে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যেটি মোটেও স্বাভাবিক নয়।”
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ বিষয়ে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সাংবাদিকরা ‘নজিরবিহীন’ স্বাধীনতা ভোগ করছেন।
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার সরকারের মতো বর্তমান সরকার গত পাঁচ মাসে কোনো কালাকানুনের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করেনি। অথবা সাংবাদিকতা করার জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি।”
“বরং, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের আমলে প্রণীত নিপীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে এবং এই আইনের অধীনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত সকল মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
“আমাদের সরকারের কাজ নিয়ে প্রচুর সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারি কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে সাংবাদিকতা করার জন্য কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, “আমরা কোনো সাংবাদিককে চাকুরিচ্যুত করিনি।”
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আন্দোলনে যাঁদের সন্তান নিহত হয়েছে, তাঁরা মামলা করেছে। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিচার চেয়ে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই।”
“প্রধান উপদেষ্টা সংবাদপত্রের সম্পাদকদের ডেকে সরকারের ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু সাংবাদিকরা যদি সেলফ সেন্সরশিপ চর্চা করেন এর দায় সাংবাদিকদের, সরকারের নয়,” বলেন শফিকুল আলম।
তবে প্রেস সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার আমলে সাংবাদিকতাকে কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিএফআই’র মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো এবং এই নিয়ম সবাই মেনেই নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, “আমি নিজে এর একজন ভিকটিম। আমি বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে যেতাম। নির্বাচনের আগে আমাকে বলা হলো, ‘আপনার ব্যাপারে আপত্তি আছে’।”
আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর “সবাই মনে করেছিলেন যে পূর্বের সেই সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা হয়নি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকারি সংস্থার পরিবর্তে এখন সমন্বয়করা নির্ধারণ করেন কে টকশোতে যাবেন, কে যাবেন না।”
“এছাড়াও যাঁরা আগামীতে ক্ষমতায় আসতে চান গণমাধ্যমে সেই রাজনৈতিক দলগুলোর আগাম হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে গেছে,” বলেন রোবায়েত।
“সুতরাং, অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তাত্ত্বিকভাবে বলা হচ্ছে দেশে মুক্ত সাংবাদিকতা করার পরিবেশ বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু সেটি নেই,” যোগ করেন তিনি।
মন্তব্য করুন: