একুশ শতকে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় অর্জন নারী জাগরণ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং আন্দোলন-প্রতিবাদে নারীর পদযাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কোনো কিছুই ত্যাগ ছাড়া অর্জিত হয় না। সাবিনারা ত্যাগ করেছেন। যে কারণে যথাসময়ে সে ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন। সম্প্রতি নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন এক সময়ে হাফপ্যান্ট ও টি-শার্টের লাল-সবুজ জার্সি পরা মেয়েরা পুরো দেশে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিলেন।
সাফজয়ী নারী দলকে স্বাগত জানাতে ব্যতিব্যস্ত পুরো মিডিয়াপাড়া। রয়েছে নানা রকম আয়োজন, ভবিষ্যতের আশ্বাসধ্বনি। সাবিনা-ঋতুপর্ণাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, তারা আনন্দে মেতে উঠছেন। তবে এ আনন্দের পেছনে প্রত্যেকেরই রয়েছে গল্পগাথা, প্রত্যেকের জীবনই সংগ্রামী গল্পে ঠাসা। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে গন্তব্যে পৌঁছার আগে স্বপ্নটা গাঁথতে হয়। যে গাঁথায় বিফলতা আসবে, বাধা ধেয়ে আসবে। কিছুদিন আগেও যারা তেমন কোনো আলোচনায় ছিলেন না। আজ ওই কয়েকটা নাম সবার মুখে মুখে। এ অর্জন অনেকটা কল্পরাজ্য জয়ের মতোই।
একুশ শতকে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় অর্জন নারী জাগরণ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং আন্দোলন-প্রতিবাদে নারীর পদযাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কোনো কিছুই ত্যাগ ছাড়া অর্জিত হয় না। সাবিনারা ত্যাগ করেছেন। যে কারণে যথাসময়ে সে ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন। সম্প্রতি নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন এক সময়ে হাফপ্যান্ট ও টি-শার্টের লাল-সবুজ জার্সি পরা মেয়েরা পুরো দেশে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিলেন। এটি শুধু একটা টুর্নামেন্ট জেতা নয়; বরং দেশের নারী ফুটবলে এক নতুন জোয়ার, যে জোয়ারের অংশীদার দেশের আপামর জনসাধারণ।
হাজারো প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে এ বন্ধুর পথে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবিনা আক্তার। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক। সাহসের প্রতিধ্বনি। বাহ্যিক অবয়ব, হাঁটাচলা এবং কথা বলায় রয়েছে ভিন্ন অভিব্যক্তি। নেতৃত্বের সব গুণ যাঁর মাঝে বিরাজমান। নেতার কাজ হলো দলকে আগলে রাখা। প্রত্যেক সদস্যকে উদ্যমী করে তোলা, যেটি সাবিনা করে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তিনি এ অর্জনকে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের জনগণের জন্য। সাতক্ষীরায় বেড়ে ওঠা সাবিনার গল্প আর দশজন প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা নারীর মতোই। ছিল না তেমন কোনো জৌলুস। চিকিৎসক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেননি; কিন্তু গোটা দেশকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার বাসনা তিনি পূরণ করেছেন। সাবিনা বলেন, ‘গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। তবে আপনাদের ভালোবাসার শক্তিকে মূল্যায়ন করতে চাই। আপনাদের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়েই বহু পথ হাঁটতে চাই। যে পথ পেরিয়ে এসেছি, তা সহজ ছিল না। বাধামুক্ত পৃথিবী গড়ার হাতিয়ার হতে পারে ফুটবল। এটি নারীকে অগ্রসর করে তোলার একটি ধাপ।’
কৃষ্ণা রানী সরকার। বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামে। বাড়ির আশপাশ প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরপুর। তাঁর হাসির ভেতর লুকিয়ে আছে গ্রামের সারল্য। বাবা একসময় দর্জির কাজ করতেন। কৃষ্ণা ও পলাশ দুই ভাইবোন। বাবার স্বল্প আয়ে বহু কষ্টে চলত সংসার। ধুলামাটির সঙ্গে বেড়ে ওঠা। টিনের ঘর। মাটির বারান্দা, যেখানে মাদুর বিছিয়ে পেতেন মায়ের ভালোবাসা। কখনও ভাবেননি, পুরো দেশের জন্য এত বড় অর্জন বয়ে আনতে পারবেন। তবে খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ ছিল তাঁর প্রিয়। বাইসাইকেল, মোটরবাইক চালাতেন। যে কারণে ছিলেন অনেকের চক্ষুশূল।
উদার মনের মেয়েটার চোখ-মুখ হাসে সব সময়। এবারও ঘাটতি নেই উদ্দামতায়। নেই কোনো আলসেমি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের যাত্রা শুরু। যে যাত্রা তাঁকে ফুটবল খেলাটি ভালোবাসতে শিখিয়েছে। কিন্তু কখনও ভাবেননি, মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এ যাত্রার কথা। ছিল প্রতিবন্ধকতা। মায়ের নিষেধ। বাবার নিমরাজি। পাড়া-মহল্লার লোকজনের টিটকারি। কৃষ্ণা বলেন, ‘আমার আগ্রহ দেখে কাকা একদিন ৩ নম্বর ডিআর বল কিনে দেন। মানুষের কটুকথা সহ্য করতে না পেরে মা একদিন বঁটি দিয়ে ফুটবল কেটে ফেলেছিলেন। তবু খেলা ছাড়িনি।’ তখন তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। ক্লাস ফোর-ফাইভের কথা। তাদের স্কুলে আরও বেশ কয়েকজন মেয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারা থেমে যান সামাজিক প্রতিবন্ধকতায়। তাঁর ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন গোলাম রায়হান বাপন। তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধার কথা জানিয়ে কৃষ্ণা বলেন, ‘স্যার আমাকে কতটা সহযোগিতা করেছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। কোনো টাকা ছিল না। গোপালপুর আসতে পারতাম না। কারণ গোপালপুর থেকে পাথালিয়া গ্রাম সাত-আট কিলোমিটার দূরে। ১৫ টাকা আসা-যাওয়ার ভাড়া ছিল। স্যার ভাড়া দিতেন, খাবার কিনে দিতেন।’ কথাগুলো বলার সময় কৃষ্ণার চোখ ছলছল করছিল।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর মানেই এক সংগ্রামের নাম। অজপাড়াগাঁয়ের মেয়েরা কী দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছেন! মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তার। মিডিয়ায় রয়েছে তাঁকে নিয়ে বেশ হৈ-হুল্লোড়। তিনি কলসিন্দুরের মেয়ে। তাঁর কথায় রয়েছে কলসিন্দুরের টান। তা পাল্টাতেও তেমন আগ্রহী নন সানজিদা। মুখে মধুর হাসি। পায়ে যেন সব অশুভকে তাড়ানোর জোর। সানজিদা বলেন, ‘আমার বেড়ে ওঠা কলসিন্দুরে। সেখানেই পড়াশোনা করেছি। ফুটবল খেলা জানতাম না। মেয়েরা ফুটবল খেলে, সেটিও জানতাম না। প্রথমে আমরা হাত দিয়ে বল খেলেছি। পা দিয়ে বল খেলতে জানতাম না। প্রথমে তো আগ্রহই ছিল না। লজ্জা পেতাম। স্যার জোর করে মাঠে নামিয়েছেন। এরপর এমন অবস্থা হলো যে ফুটবল না খেললে ভালো লাগত না। এক ধরনের নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বকাঝকা শুরু হয়; কিন্তু কারও কথা না শুনে স্কুল ছুটির পর চুরি করে খেলতাম। পাড়া-পড়শীর কটুকথা শুনতে হয়েছে। তবে এখন সমাজে সমর্থন বেড়েছে।’
সম্প্রতি বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। নতুনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা পাচ্ছে সর্বস্তরের মানুষ। এ সময় নারী দলের সাফ জয়ের ইতিহাস আরও সাহস জোগায়; জয়ের প্রেরণা তৈরি করে। তবে এ অর্জনের মাঝেও কিছু কষ্টের স্মৃতি রয়েছে, যার কথা ভুলে যাননি সাবিনা-কৃষ্ণারা। প্রথমবার সাফজয়ী নারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন রাজিয়া সুলতানা। বাবা মারা গেছেন যক্ষ্মায় ভুগে, মায়ের দিন কাটে গোবরে ঘুঁটে বানিয়ে। মেয়ের স্বপ্ন আকাশছোঁয়া, তবুও অভাব যেন নিত্যসঙ্গী। বিয়ের কথা গোপন করে পেটে সন্তান নিয়ে ফুটবল খেলেছেন। ১৩ মার্চ রাতে সন্তান জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান রাজিয়া। এই করুণ ঘটনা আমাদের সমাজ বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে।
মন্তব্য করুন: