আওয়ামী লীগের নজর ছিল মূলত বড় প্রকল্পে। প্রায় পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঢাকার যোগাযোগ খাতে। বড় অঙ্কের কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কয়েকটি বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু শৃঙ্খলা ফেরানোর বেলায় ওবায়দুল কাদের ছিলেন হাত গুটিয়ে। তৎকালীন মেয়ররা বৈঠকের পর বৈঠক করেছেন। কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কাজের কাজ হয়নি।
মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ ও ব্যবস্থাপনা—এ দুটি হলেই ঢাকার বাসিন্দারা বাসে আরামদায়কভাবে যাতায়াত করতে পারতেন। ঢাকার যানজটও কমত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সে সময়ের ঢাকার দুই মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম তা করেননি। ফলে ঢাকায় বাস চলাচলের নামে চলেছে আসলে নৈরাজ্য।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাস চলাচলে সেই নৈরাজ্য রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাসে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন বাস নামানো ও সব বাসকে একই কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসার আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন করে উদ্যোগী হয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাড়তি তৎপরতা দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ বিষয়ে বলেন, বাসে শৃঙ্খলা ফেরানো অগ্রাধিকারে আছে। বিষয়টি নিয়ে একটি অবস্থানপত্র তৈরি করা হয়েছে। শিগগিরই অংশীজন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিয়ে একটি সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পরিকল্পনা কী ছিল
ঢাকার বাসে শৃঙ্খলা ফেরাতে পরিকল্পনাটা ছিল এমন যে সব বাস অল্প কিছু কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা হবে। এতে প্রত্যেক মালিক তাঁর বিনিয়োগের হার অনুসারে লভ্যাংশ পাবেন। আর প্রতিটি কোম্পানির বাসের রং হবে আলাদা। একটার পর একটা বাস সময় মেনে চলবে। পথে কেউ কারও আগে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। ফলে এলোমেলো বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানোর চেষ্টা থাকবে না। বাসে উঠতে মারামারি, টানাটানি, ধাক্কাধাক্কিও হবে না। নগরের যানজটও কমে যাবে। এই ব্যবস্থার নাম বাস রুট র্যাশনালাইজেশন বা বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ।
এ ব্যবস্থায় পুরোনো বাস তুলে দিয়ে নতুন বাস নামানোর কথা ছিল। এ জন্য দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রয়োজন হবে বলে হিসাব করা হয়েছিল। তা–ও সরকারকে নিজে খরচ করতে হবে না। পরিবহনমালিকদের সহজ শর্তে, কম সুদে ঋণ দিলেই চলবে।
ঢাকায় বাসের শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৫ সালে প্রথম রুট র্যাশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি নতুন বাস নামাতে অর্থায়ন জোগাড় করা, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের রাজি করাতে ২৫টির মতো বৈঠক করেন। সবকিছু গুছিয়ে আনার পর আনিসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তিনি মারা যান।
উদ্যোগটি বাস্তবায়নে ২০১৮ সালে নতুন কমিটি হয় এবং এর নেতৃত্বে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি কিছু বৈঠক করা ছাড়া অগ্রগতি দেখাতে পারেননি। ২০২০ সালে দক্ষিণ সিটির মেয়র হন শেখ ফজলে নূর তাপস। উত্তরে মেয়র হন আতিকুল ইসলাম।
তাপস ও আতিক মেয়র থাকার সময় ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে বিআরটিসির দ্বিতল বাস দিয়ে একটি রুট (পথ) চালু করা হয়। পথটি হলো কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর, প্রেসক্লাব, জিগাতলা হয়ে মোহাম্মদপুর। পরে আরও দুটি রুট চালু হয়েছিল। যদিও সেগুলো আর কার্যকর নেই। প্রস্তাবিত একটি রুট চালুই হয়নি।
ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী
পরিবহন–সংশ্লিষ্ট সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম বিনিয়োগ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা—এটাই হচ্ছে রুট র্যাশনালাইজেশনের মূলমন্ত্র। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে দুটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, বিগত সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বড় ব্যয়ের মেগা প্রকল্প, যা থেকে রাজনীতিক, আমলা ও ঠিকাদারেরা সুবিধা পেয়েছেন। এ জন্য কম বিনিয়োগ ও বাড়তি পরিশ্রমের রুট র্যাশনালাইজেশনের উদ্যোগ সফল হয়নি।
দ্বিতীয়ত কারণ, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অসহযোগিতা। কারণ, সীমিত কিছু কোম্পানির অধীনে কেন্দ্রীয়ভাবে বাস পরিচালনা করলে মালিক-শ্রমিক সমিতি এবং কোম্পানির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকেরা চাঁদা তুলতে পারবেন না।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকাসহ সারা দেশের যানবাহন থেকে বছরে অন্তত ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। গত ৫ মার্চ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ পান দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। গবেষণায় আরও এসেছে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা পরিবহন খাতে যুক্ত ছিলেন, পটপরিবর্তনের পর তাঁরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণেও হাতবদল হয়েছে। কিন্তু বাসগুলো সেই লক্কড়ঝক্কড় রয়ে গেছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বর্তমান বিএনপিপন্থী আহ্বায়ক সাইফুল আলম এ বিষয়ে বর্তমান নগর পরিবহনের বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, সরকার যদি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে কোনো উদ্যোগ নেয়, তাতে তাঁদের সমর্থন থাকবে।
পরিবহন মালিক সমিতির এই নেতা আরও বলেন, সরকার স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে নতুন বাস নামানোর উদ্যোগ নিলে মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে তাঁরা এই উদ্যোগে শামিল হবেন।
কার জন্য করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছয়টি লাইনের মাধ্যমে ১৩০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় বিগত সরকার। এর অন্তত তিনটি লাইন নির্মাণে প্রকল্প চলমান। বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশ চালু হয়েছে। কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করার কাজ চলমান। এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চালু হওয়া এবং নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের পেছনে ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা উড়ালসড়ক, মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক, মগবাজার উড়ালসড়ক এবং ঢাকা-আশুলিয়া উড়ালসড়ক। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বাসের বিশেষ লেন (বিআরটি) প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রায় এক দশক ধরে এই প্রকল্পের কারণে ঢাকার উত্তরের মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এর বাইরে সংকেতবাতি বসানোসহ অন্যান্য কাজে আরও ব্যয় হাজার কোটি টাকার মতো। সব মিলিয়ে শুধু ঢাকার যানজট নিরসনে বাস্তবায়িত ও চলমান প্রকল্পের ব্যয় তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এর সব কটিই কেনাকাটা ও বড় অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানতে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, এর ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় ও লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পে অনিয়ম এবং ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
বাসের শৃঙ্খলা কেন জরুরি
ঢাকার যানজট নিরসন ও গণপরিবহনব্যবস্থা আধুনিকায়নে ২০০৫ সালে ২০ এসটিপি প্রণয়ন করে সরকার। ২০১৫ সালে পরিকল্পনা সংশোধন করে করা হয় আরএসটিপি। যার মেয়াদ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। এসটিপি ও আরএসটিপিতে মেট্রোরেল, উড়ালসড়ক, বিআরটিসহ নানা অবকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এসব মেগা প্রকল্পের সুফল পেতে এবং নির্মাণের সময় মানুষের কষ্ট লাঘবে সবার আগে বিদ্যমান বাস–ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে বাস রুট র্যাশনালাইজেশনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো আগে নেওয়া হলেও বাসের শৃঙ্খলা আনার কাজটি কখনোই গুরুত্ব পায়নি।
এসটিপি অনুসারে, ঢাকা ও এর আশপাশে গণপরিবহনের যাত্রীদের ৫৮ শতাংশ বাসে যাতায়াত করেন। বাস-মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশা ও কার—এই তিন শ্রেণির যানের মধ্যে বাস-মিনিবাসে ৭২ শতাংশ ট্রিপ (যাত্রা) হয়। যত ধরনের গণপরিবহন আছে, এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের ভাড়া সবচেয়ে কম।
ডিটিসিএ ও পরিবহনের মালিকদের মতে, রাজধানী ও এর আশপাশের জেলাগুলোতে চার হাজারের মতো বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। অর্থাৎ ঢাকার মোট যানবাহনের মাত্র দশমিক ১৮ শতাংশ বাস-মিনিবাস। এসব বাসের অধিকাংশ আবার জরাজীর্ণ, লক্কড়ঝক্কড়। কোনো বাসেরই দরজা-জানালা পুরোপুরি ঠিক নেই। অধিকাংশ বাস-মিনিবাসের বসার আসন তেল চিটচিটে, ময়লায় ভরা। নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়তি আসন বসানোর কারণে বসার যাত্রীদের পা আটকে যায়। আর দাঁড়ানো যাত্রী ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারেন না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, সব কটি মেট্রোরেল, বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও ঢাকা ও এর আশপাশের মানুষের ২০ শতাংশ যাতায়াতের চাহিদা পূরণ হবে। ঢাকার মানুষের কাছে এখনো মূল গণপরিবহন বাস। এটি শৃঙ্খলায় না এনে যেকোনো পরিকল্পনা, প্রকল্প কিংবা উদ্যোগ সফল হবে না। বাসগুলো অল্প কিছু কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি খুবই দক্ষ একটি ব্যবস্থা। তবে কঠোর তদারকি আর ব্যবস্থাপনার জন্য পেশাদার নিয়ন্ত্রক সংস্থা লাগবে।
মন্তব্য করুন: