ajbarta24@gmail.com সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

চেহারা নিখুঁত করতে ১০০ বার অস্ত্রোপচার করিয়েছেন চীনা এই নারী!

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:০৪ পিএম

ফাইল ছবি

প্রথমবার যখন অ্যাবি উর অস্ত্রোপচার হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর।

হরমোনজনিত অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা নেওয়ার পর অ্যাবির ওজন দুই মাসে ৪২ কেজি থেকে বেড়ে ৬২ কেজি হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় অ্যাবি তাঁর নাট্য ক্লাসের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার এই যে পরিবর্তন, সেটা তাঁর নাট্য শিক্ষকের চোখ এড়ায়নি।

তখনকার কথা মনে করে অ্যাবি বলেন, ‘আমার শিক্ষক বলেছিলেন, “তুমি তো আমাদের তারকা শিল্পী। কিন্তু এখন তুমি অনেক মোটা হয়ে গেছ। হয় ছেড়ে দাও, নয়তো দ্রুত ওজন কমাও।”’

অ্যাবির মা তখন তৎপর হলেন। তাঁকে পেট ও পা থেকে চর্বি অপসারণের জন্য লাইপোসাকশন করাতে নিয়ে গেলেন।

অ্যাবি যখন হাসপাতালের গাউন পরে অস্ত্রোপচারের জন্য বিচলিতভাবে অপেক্ষা করছিলেন, তখন তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘মনে সাহস রাখো এবং ভেতরে যাও। বের হওয়ার পর তোমাকে দারুণ দেখাবে।’

অস্ত্রোপচারটি ছিল যন্ত্রণাদায়ক। অ্যাবিকে কেবল আংশিক অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়েছিল এবং পুরো সময়টাতেই তাঁর জ্ঞান ছিল।

অ্যাবি বলেন, ‘আমার শরীর থেকে কতটা চর্বি বের করা হচ্ছে এবং আমি কতটা রক্ত ​​হারাচ্ছি, তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।’

এখন অ্যাবির বয়স ৩৫ বছর। এ সময়ের মধ্যে তিনি ১০০টির বেশি অস্ত্রোপচার করিয়েছেন, যার খরচ পাঁচ লাখ ডলার।

অ্যাবি এখন বেইজিংয়ের একটি বিউটি ক্লিনিকের অংশীদার। চীনে প্লাস্টিক সার্জারির উত্থানের ক্ষেত্রে অবদান রাখা উল্লেখযোগ্য মানুষের একজন হয়ে উঠেছেন তিনি।

তবে এতগুলো অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তাঁর শরীরকে অনেক ধকল সইতে হয়েছে।

বেইজিংয়ে অ্যাবির বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, তিনি একটি আয়নার সামনে বসে মুখে কনসিলার লাগাচ্ছেন। সম্প্রতি মুখ পাতলা করার ইনজেকশন নেওয়ার কারণে তৈরি হওয়া দাগ ঢাকার চেষ্টা করছেন তিনি।

এ ইনজেকশনটি অ্যাবি প্রতি মাসে নেন যেন মুখ আরও টানটান ও কম মোটা দেখায়। এর আগে অতিরিক্ত হাড় কমাতে চোয়ালে তিনটি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।

তবে এসব অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যাবির মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা নেই। তিনি মনে করেন, সে সময় তাঁর মায়ের সিদ্ধান্তটিই সঠিক ছিল।

অ্যাবি বলেন, ‘অস্ত্রোপচারগুলো কাজে দিয়েছে। আমি দিন দিন আরও আত্মবিশ্বাসী ও সুখী হয়ে উঠেছি। আমি মনে করি, আমার মা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন।’

অ্যাবি উর নাকজুড়ে পুরু করে বাদামি প্লাস্টার লাগানো এবং মুখের বড় একটা অংশ ঢেকে রাখা। তাঁর চিবুক পর্যন্ত সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো আর মুখের কিছু অংশে ক্ষত ও রক্তের চিহ্ন।

ট্যাবু ভেঙে গত ২০ বছরে চীনে প্লাস্টিক সার্জারি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আসার কারণে এমনটা হয়েছে।

প্রতিবছর চীনের দুই কোটি মানুষ কসমেটিক সার্জারির জন্য অর্থ খরচ করেন।

চীনে প্লাস্টিক সার্জারির প্রতি আগ্রহ সবচেয়ে বেশি তরুণীদের মধ্যে। পরিসংখ্যান বলছে, যাঁরা এ ধরনের অস্ত্রোপচার করাচ্ছেন তাঁদের ৮০ শতাংশই নারী। তাঁদের গড় বয়স ২৫ বছর।

চীনা সংস্কৃতিতে সৌন্দর্যের গুরুত্ব বরাবরই ছিল, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে সৌন্দর্য নির্ধারণের মানদণ্ডে পরিবর্তন আসছে।

বছরের পর বছর ধরে চীনে সৌন্দর্যের মানদণ্ডগুলো পশ্চিমা আদর্শ, অ্যানিমে কল্পনার সৌন্দর্য এবং কে-পপ তারকাদের অনুপ্রেরণার একটি মিশ্রণ ছিল। এই সৌন্দর্য ধারণার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল—ডাবল আইলিড, ছাঁটা ও খাঁজকাটা চোয়াল, চোখে পড়ার মতো নাক এবং নিখুঁত মুখাকৃতি।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে কষ্টকর প্রক্রিয়াগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অবাস্তব ও অতিরিক্ত নারীসুলভ এবং বয়স কম দেখানোর মতো সৌন্দর্যের ধারণার পেছনে ছোটা হচ্ছে।

এখন কানের পেছনে বটক্স ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে, যেন কান সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে এবং মুখ ছোট ও কোমল দেখায়।

নিচের চোখের পাতায় অস্ত্রোপচারও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চোখ বড় ও উজ্জ্বল দেখাতে এমনটা করা হয়। এটা একধরনের নিষ্পাপ ও শিশুসুলভ চেহারা তৈরি করে।

তবে এ সৌন্দর্যের অনেকটাই তৈরি করা হয় পর্দায় প্রদর্শনের জন্য। ফিল্টার ও রিং লাইটের আলোয় এসব রূপান্তরকে নিখুঁত ও দৃষ্টিনন্দন বলে মনে হয়। তবে বাস্তব জীবনে এই মুখগুলোকে অদ্ভুত মনে হয়। এমন এক মুখ, যা মানুষের মতো নয়, আবার শিশুর মতোও নয়।

‘আমার ত্বকে যেন সিমেন্ট ঢালা হয়েছে’

চীনে কসমেটিক সার্জারির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে দ্রুতগতিতে নতুন নতুন সার্জারি ক্লিনিক গড়ে উঠছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব ক্লিনিকে যোগ্য সার্জনের অভাব আছে। তা ছাড়া অনেক ক্লিনিক কোনো লাইসেন্স ছাড়াই চালানো হচ্ছে।

বাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইরিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত হিসাবে চীনে লাইসেন্স ছাড়াই প্রায় ৮০ হাজার ক্লিনিকে কসমেটিক সার্জারি সেবা দেওয়া হয়। প্রায় এক লাখ সার্জন যথাযথ প্রশিক্ষণ বা যোগ্যতা ছাড়াই কাজ করেন। এর ফলে চীনের কসমেটিক সার্জারি ক্লিনিকগুলোতে প্রায়ই অঘটন ঘটছে।

প্লাস্টিক সার্জন ও সাংহাইয়ের একটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত কসমেটিক সার্জারি ক্লিনিকের মালিক ইয়াং লু বলেন, গত কয়েক বছরে ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে ক্ষতির শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

ইয়াং লু বলেন, ‘আমি অনেক রোগীকে পেয়েছি যাদের প্রথম সার্জারিটি অনুমোদনহীন ক্লিনিকে যাওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এমনকি কেউ কেউ কারও বাসার ভেতরেই সার্জারি করিয়েছেন।’

২৮ বছর বয়সী ইউয়ে ইউয়ে তেমনই একজন। তিনি সৌন্দর্যচর্চার নামে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন।

২০২০ সালে ইউয়ে ইউয়ে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর চালানো লাইসেন্সবিহীন একটি ক্লিনিকে গিয়ে বেবি ফেস কোলাজেন ইনজেকশন নেন। মুখকে কোমল দেখানোর জন্য এমনটা করেছিলেন।

তবে ইনজেকশন নেওয়ার পর ফিলার শক্ত হয়ে জমে যায়।

ইউয়ে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, ত্বকের ভেতরে সিমেন্ট ঢেলে রাখা হয়েছে।’

ক্ষতি সারাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোঁজ মেলা বেশ কিছু জনপ্রিয় ক্লিনিকের শরণাপন্ন হন ইউয়ে ইউয়ে। তবে তাতে তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

একটি ক্লিনিক সিরিঞ্জ দিয়ে ফিলার বের করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে শক্ত পদার্থ বের না করে বরং তার নিজের টিস্যুই টেনে বের করে আনা হয়। এতে ইউয়ে ইউয়ের ত্বক ঝুলে যায়।

পরে ইউয়ে গত বছর চিকিৎসক ইয়াংয়ের খোঁজ পান। তখন থেকে তাঁর তিনটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। ইয়াং অস্ত্রোপচার করার কারণে ইউয়ে ইউয়ের উন্নতি হলেও তাঁর কিছু সমস্যা আজীবনের জন্য থেকে যেতে পারে।

ইউয়ে ইউয়ে বলেন, ‘আমি আর সুন্দর হতে চাই না। এখন আমি আগে যেমন ছিলাম, তেমন অবস্থায় ফিরে যেতে পারলেই খুশি হব।’

চীনের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য কমিশন কয়েক বছর ধরে অযোগ্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরার চেষ্টা করছে। এরই অংশ হিসেবে তারা কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে আরও কড়া নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এর পরও বাস্তবে এই সমস্যা থেকেই যাচ্ছে।

সোর্স: প্রথম অলো 

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর