চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশকে শিল্পায়নের কেন্দ্রস্থল (ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব) হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে সুপরিচিত করতে চান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এজন্য বহির্বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের বিশ্বস্ততা অর্জনে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ থাকা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্বস্ততা অর্জন একটা বড় শর্ত। সেই শর্ত পূরণ করতে প্রথমে নিজেদের ঘর গুছিয়ে অর্থাৎ, প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়ে দৃশ্যমান বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘কয়েক দশক আগেও চীন অর্থনৈতিকভাবে এত উন্নত ছিল না। অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে তারা প্রথমে নিজেদের ঘর গুছিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার থেকে তাদের দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট ও উৎসাহিত করতে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘নিজেদের ঘর গোছানোর পর তারা বিভিন্ন দেশকে তাদের দেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এরপর বিভিন্ন দেশ চীনে গিয়ে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দেখার পর বিনিয়োগ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব হিসেবে সুপরিচিত করে তুলতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ার কাজ করছে।’
ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করতে তিনি তাদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন। যা বাংলাদেশের অতীতের সরকারপ্রধানদের জন্য সহজ ছিল না।’
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর উপলক্ষে ৩০ মার্চ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রায় সময় একটা কথা বলেন, কোথায় কোন তালা খুলতে হবে আমাকে বলেন, আমি তালা খুলে দেবো (অর্থাৎ কোনো দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে কী সমস্যা রয়েছে)। চীন সরকারের আমন্ত্রণে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের বাধা হিসেবে যে তালা ছিল তা চাবি দিয়ে খুলে দিয়েছেন। শুধু চীন নয়, অন্য দেশের ক্ষেত্রেও বাধা থাকলে তিনি তার সুপরিচিতি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে বাধা দূর করবেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত আরও বলেন, কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সাধারণত তিনি বাইরে বের হয়ে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে থাকেন না। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার জন্য তিনি গ্রেট হল থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চীনের প্রেসিডেন্ট সাধারণত গ্রুপ ফটো তোলেন না। বাংলাদেশের জন্য ব্যতিক্রম উদাহরণ তৈরি করে তিনি হাসিমুখে গ্রুপ ফটো তোলারও সুযোগ করে দিয়েছেন।
গত ২৮ মার্চ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় ড. ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বাংলাদেশে চীনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের জন্য সবুজ সংকেত দেওয়ার অনুরোধ করেন। এসময় প্রেসিডেন্ট শি চীনা কোম্পানিগুলোকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে উৎসাহিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু তাই নয়, সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি তদারকি করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
একই দিন শীর্ষ চীনা কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চীনের ১০০টিরও বেশি শীর্ষ উদ্যোক্তা ও সিইওর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বাংলাদেশকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ তুলে ধরেন।
এসময় প্রধান উপদেষ্টা তাদের বলেন, বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর করা হলে চীনা বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের সুবিধা পাবেন। কারণ বাংলাদেশে কোনো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নেই এবং এটি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিচ্ছে। এটাই বাংলাদেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময়।
বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, যা নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিনিয়োগ সংলাপের পর বিভিন্ন খাতের নেতাদের সঙ্গে তিনটি রাউন্ড টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেয় বিশ্বের বৃহত্তম সৌর প্যানেল নির্মাতা লঙ্গি, মোবাইলফোন নির্মাতা অপো, চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি হিসেনসি ইন্টারন্যাশনাল, চায়না বায়োটেক অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ভ্যালি, চায়না ইন্টারনেট, চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, চায়না রেলওয়ে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এরপর চীনা সরকার ও কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পায় বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঐতিহাসিক সফরের ফলস্বরূপ এ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ৩০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে এক্সক্লুসিভ চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, মোংলা বন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪শ মিলিয়ন ডলার ঋণ, চায়না ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য ১৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার পরিকল্পনা।
এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকালে বাংলাদেশের রোগীদের উন্নতমানের সেবা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণেরও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। মাত্র দুই ঘণ্টায় চীনে পৌঁছে সেখানকার চারটি হাসপাতালে উন্নতমানের সেবা পাওয়ারও ব্যবস্থা করেছে সরকার।
সূত্র: জাগোনিউজ
মন্তব্য করুন: