ajbarta24@gmail.com মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
২ বৈশাখ ১৪৩২

বাংলা নববর্ষ: ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নবযাত্রা

মাইশা মমতাজ

প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ২০:০৪ পিএম

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ, যা সাধারণত ইংরেজি এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ভোজনরীতি, যা যুগযুগান্তর ধরে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। নববর্ষ মানেই নতুন বছরের নতুন সকাল, নতুন কল্পনা, নতুন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সুবাস। তবে এই দিনটির কিছু ঐতিহ্য কালের বিবর্তনে বদলে গেলেও, কিছু প্রথা এখন

বৈশাখে লাল-সাদা পোশাক: ঐতিহ্যের উৎস

পহেলা বৈশাখে লাল-সাদা জামাকাপড় পরার রীতি বাঙালি সমাজে চিরকালীন। এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণ। লাল-সাদা রঙের সংমিশ্রণটি মূলত হালখাতার প্রথা থেকে এসেছে, যেখানে খাতার মোড়ক ছিল লাল রঙের এবং ভেতরের পাতাগুলি ছিল সাদা। অন্যদিকে, সনাতন ধর্মের পূজা-পার্বণে সাদা জমিনে লাল পাড়ের শাড়ি পরার প্রচলনও এই রীতির প্রেক্ষাপট হতে পারে। লাল রঙের মধ্য দিয়ে আশা এবং শক্তির প্রতীক, আর সাদা রঙ শুভ্রতার প্রতীক। এই কারণে পহেলা বৈশাখে সাদা ও লাল রঙের সমন্বয় নতুন আশার প্রতীক হয়ে ওঠে।

 

পান্তা ইলিশ: বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য

পান্তাভাত খাওয়ার ঐতিহ্য বাংলার কৃষি জীবন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। পান্তার উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারায়, বিশেষত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী 'কালকেতুর ভোজন' এ পান্তার জলীয় অংশের বর্ণনা দিয়েছেন। ঐ সময় পান্তা খাওয়া ছিল কৃষকদের শারীরিক শক্তির উৎস, যেহেতু তারা সকালে সূর্যোদয়ের পর পান্তা খেয়ে মাঠে কাজ করতে যেতেন।

পান্তা খাওয়ার সঙ্গে পরবর্তীতে যুক্ত হয় নানা তরকারি বা মাছ, যেমন আলু ভর্তা, পোড়া বেগুন এবং পুকুরে পাওয়া ছোট মাছ। তবে ইলিশ মাছ ছিল বেশ দুর্লভ, এবং তার দাম ছিল অনেকটা বেশি। ১৯৮০ সালে সাংবাদিক বোরহানউদ্দিন আহমেদ প্রথম পান্তা ইলিশের আয়োজন করেন, যা সেখান থেকেই জনপ্রিয় হতে থাকে। এই ঐতিহ্য নববর্ষের প্রধান খাদ্য হিসেবে এখনো বাঙালি ঘরে ঘরে পালিত হয়, যদিও ইলিশের দাম বাড়ার ফলে কিছুটা কম দেখা যায়।

 

হালখাতা: ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের সুরভি

হালখাতা বাংলার এক পুরনো ব্যবসায়িক প্রথা। পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরনো হিসাব শেষ করে নতুন বছরের শুরুতে নতুন খাতায় হিসাব-নিকেশ করতে শুরু করতেন। মুঘল আমলে বাদশাহ আকবরের আমল থেকে এই প্রথার সূচনা হয়, যখন খাজনা প্রদান করার জন্য 'হালখাতা' খোলার প্রথা চালু হয়। 'হাল' মানে নতুন এবং 'হালখাতা' মানে নতুন খাতা।

একসময়, এই দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনাপাওনার হিসাব মিটিয়ে ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। হালখাতা ছিল বাংলা নববর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। যদিও এখন এই প্রথা অনেকটা কমে গেছে, তবে ঢাকার পুরান বাজারে এবং কিছু ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক পরিবারে এটি এখনও পালন করা হয়। বিশেষ করে স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে বড় আড়ম্বরে হালখাতার আয়োজন করা হয়, এবং এর সাথে মিষ্টিমুখ ও সুগন্ধি পান বিতরণের রীতি রয়ে গেছে।

 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা নববর্ষের আয়োজন

বর্তমানে পহেলা বৈশাখে কিছু ঐতিহ্য পরিবর্তিত হলেও, এটি এখনো বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিনটি শুধুমাত্র নতুন বছরের আগমনই নয়, বরং একটি নতুন শুরুর প্রতীক। ফ্যাশন হাউসগুলো প্রতি বছর বৈশাখী পোশাকের মাধ্যমে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে এবং রঙে পরিবর্তনও দেখা যায়। তবে, অতীতের মতো লাল-সাদা রঙের পোশাকের প্রচলন এখনও রয়েছে। পাশাপাশি, পান্তা ইলিশের আয়োজন ও হালখাতার অনুষ্ঠানে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য জীবন্ত রয়ে গেছে, যা নববর্ষের আনন্দকে আরও বৃদ্ধি করে।

 

বাংলা নববর্ষ, বা পহেলা বৈশাখ, বাঙালির জীবনে এক নতুন সূর্যোদয়ের মতো। এই দিনটি শুধু নতুন বছরের আগমন নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং আনন্দের এক অমূল্য অংশ। যে প্রথাগুলি যুগের পর যুগ বাঙালি সমাজে লালিত-পালিত হয়েছে, তা এখনও মানুষের মনে সজীবভাবে স্থান করে নিয়েছে, এবং নববর্ষের আনন্দকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে।

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর