নাফিজের মরদেহ ঝুলছিল রিকশায়—দেশজুড়ে কাঁদিয়েছিল ছবিটি। ছবিটি যখন তোলা হচ্ছিল, গুলিবিদ্ধ কলেজছাত্র গোলাম নাফিজ তখনও রিকশার রড ধরে রেখেছিলেন, ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যাচ্ছিলেন।
যেদিন তার দেহ ওই রিকশায় তোলা হয়েছিল, চালক ছিলেন নূর মোহাম্মদ। গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের ভয়াল মুহূর্ত ভোলেননি তিনি। সেই রিকশা পরে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন লন্ডনপ্রবাসী আহসানুল কবীর সিদ্দিকী কায়সারের কাছে।
এখনো রিকশা চালিয়েই নিজের মা-বাবা, স্ত্রী, দুই সন্তান ও বোনের সংসার চালান তিনি। তবে দিনের শেষে চোখে ভাসে একটিই চাওয়া—সরকারি কোনো চাকরি।
গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর ফার্মগেটে গুলিবিদ্ধ নাফিজকে প্রথম হাসপাতালে নিয়ে যান তিনিই। সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ—যা বহু মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়েছিল। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নূর মোহাম্মদ ফিরে গেছেন সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিতে।
তিনি বলেন, ধানমন্ডি থেকে যাত্রী নামিয়ে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ চারদিক থেকে গুলির শব্দ, একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে বেঁচে ফেরার প্রার্থনা—‘বারবার ইন্না লিল্লাহ পড়ছিলাম’।
ফার্মগেট পুলিশ বক্স পার হওয়ার পর বিজ্ঞান কলেজের সামনে তাকে থামিয়ে তাদের (পুলিশের) সঙ্গে যেতে বলে। আমি তখন বলি, কোথায় যাবো? ওদিকে গোলাগুলি হচ্ছে, ওদিকে কোথায় যাবো? তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘তোকে আসতে বলেছি আয়।’ এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তখন দোয়া পড়তে থাকি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আজ আমি শেষ। আল্লাহ জানে কপালে কী আছে।
পুলিশ প্রথমে একটি টুকরির দিকে ইশারা করে বলেন তুলতে। নূর মোহাম্মদ ভেবেছিলেন সেটিই বোঝা। পরে পাশেই পড়ে থাকা এক যুবককে দেখিয়ে পুলিশ বলে, ‘আরে বেটা লাশ ফালাই রাখছি, দেখছ না? এইডা তোল।’ এরপর আমাকে গালাগালি শুরু করে। আমি ওই ছেলের পেছন দিক দিয়ে ধরে উঠানোর চেষ্টা করি আর পুলিশ দুই পা ধরে উঠিয়ে রিকশার পাদানিতে ছুড়ে ফেলে। এ সময় পুলিশ সদস্যরা একজন আরেকজনকে বলছিল, ‘আরও দুইটা গুলি কইরা দে, বেঁচে যাইতে যেন না পারে।’ এমনকি তাকেও গুলি করার হুমকি দেওয়া হয়।
নুর মোহাম্মদ বলেন, রিকশা চালাতে শুরু করার পর দেখা যায়, ছেলেটি পড়ে যাচ্ছে। তখন আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘শোয়ায়ে দে।’ এরপর দেখি ছেলেটার হাত রিকশার চেইনে আটকে যাচ্ছে। তাই হাতটা টেনে রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখি। এরপর একাই নিয়ে যান আল রাজি হাসপাতালে, তারপর চক্ষু হাসপাতালে। কেউ বলেন, ঢাকা মেডিকেল বা সোহরাওয়ার্দীতে নিতে। এক অটোচালককে অনুরোধ করে বলেন, ‘বাঁচে তো ভালো, না বাঁচলে লাশ যেন সরকারি হাসপাতালে থাকে, বাবা-মা খুঁজে পাবে।’ কিন্তু ছেলেটির পকেটে কোনো ঠিকানা ছিল না। আফসোস করে বলেন, ‘যদি কেউ একটু ধরে রাখতো, আমি দ্রুত চালিয়ে নিতে পারতাম, হয়তো বেঁচে যেতো।’
পুলিশের চোখের সামনেই ছবিটি তুলছিলেন সাংবাদিক জীবন আহমেদ। তাকে দেখে পুলিশ হুমকি দেয়, ‘তোকেও ক্যামেরাসহ পুড়িয়ে দেবো।’ এরপর সোহরাওয়ার্দীতে নাফিজকে নিয়ে যাওয়া হয়।
নুর মোহাম্মদ বলেন, ঘটনার একদিন পর নাফিজের মামা পত্রিকায় ছবি দেখে খোঁজ নেন। পত্রিকা অফিস থেকে জীবন আহমেদ রিকশার পেছনে থাকা নম্বর দিয়ে দেন। সেখান থেকেই ফোন আসে নূর মোহাম্মদের কাছে। তিনি বলেন, ‘জানার পর খুব খারাপ লেগেছে, ছেলেটি যদি বেঁচে থাকতো, নিজের কাছে ভালো লাগতো।’
আর সেই রিকশা? চালাতে আর মন চায়নি তার। যখনই রিকশায় হাত রাখেন, চোখে ভেসে ওঠে রক্তমাখা দৃশ্য। তাই ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন। বলেন, ‘ইচ্ছে করলে ১০-২০ কোটি টাকা চাইতে পারতাম, চাইনি।’ সেই রিকশা এখন আছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে’—যেখানে দিয়েছিলেন সেই প্রবাসী ক্রেতা।
তার মনেপ্রাণে একটা ইচ্ছা—প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সেদিনকার একটা পতাকা আছে, আর একটি রাখালের লাঠি। এগুলো তাকে দিতে চাই। উনি খুশি হয়ে যা দেন তাই নেবো, একটা সুতা দিলেও।’
তবে প্রতিশ্রুতি যারা দিয়েছিলেন, তারা কথা রাখেননি বলেই অভিযোগ নূর মোহাম্মদের। রিকশাটি স্মৃতি জাদুঘরে হস্তান্তরের সময় তৎকালীন উপদেষ্টা ও বর্তমান এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাননি। তার ভাষায়, ‘ছয়জনের সংসার একাই চালাই। দিনে ৫০০ টাকা ইনকাম করতেও কষ্ট হয়।’ এনসিপির অফিস, নগর ভবন, শিল্পকলায় গিয়েছেন, নাহিদ ইসলাম বা আসিফ মাহমুদের সঙ্গেও দেখা করেছেন—কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি।
সরকারের কাছে কি কোনো প্রত্যাশা? নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি চাই একটা চাকরি। আমার না হলে অন্তত ছেলেটার জন্য। আর কিছু চাই না।’
সাক্ষাৎকারে জানালেন, দিনাজপুরের বীরগঞ্জে তার পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে রেখেছে মফিজ উকিল নামের এক ব্যক্তি। বছরে দুই লাখ টাকা দেওয়ার চুক্তি থাকলেও কিছুই দেয়নি সে। কাগজপত্র সব আছে, তবু জমি উদ্ধার করতে পারেননি। ভূমি অফিস থেকে শুরু করে বহু দপ্তরে ঘুরেও প্রতিকার মেলেনি। ওই ব্যক্তি একসময় আওয়ামী লীগ করলেও এখন বিএনপির সঙ্গে জড়িত বলেও জানান তিনি।
সোর্স: ইত্তেফাক
মন্তব্য করুন: