[email protected] বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

যে জুলাই ছিল ‘৩৬ দিনের’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১ জুলাই ২০২৫ ১৭:০৭ পিএম

ফাইল ছবি

২০২৪ সালের জুলাই মাস ৩১ দিনের হলেও ক্যালেন্ডারের পাতায় তাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলনের উত্তাপে মাসটি হয়ে উঠেছিল ৩৬ দিনের দীর্ঘ এক সংগ্রামের নাম। এই ‘৩৬ জুলাই’ শুধু একটি প্রতীকী তারিখ নয়— এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য নতুন অধ্যায়।

রক্তাক্ত সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘৩৬ জুলাই’ হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের মুহূর্ত।

সরকারি চাকরিতে ‘কোটা প্রথা’ বাতিলের দাবিতে অরাজনৈতিক ব্যানারে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি, যা ধীরে ধীরে পরিণত হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ৭২ সাল থেকে চলে আসা বৈষম্যমূলক পদ্ধতি সংস্কার চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করা হয়, চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে। লাগাতার আন্দোলনে ক্ষুব্ধ ও বাধ্য হয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৪৬ বছরের কোটাব্যবস্থা বাতিল করে দেন শেখ হাসিনা।

কোটা বাতিলের কয়েক বছর না যেতেই ‘দুষ্টু বুদ্ধি’ মাথায় আসে তখনকার সরকারের। ২০২৪ সালের ‘৫ জুন’ আবার বহাল করানো হয় আদালতের মাধ্যমে। এতে আবারও শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। এরপর ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে আল্টিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা। চলতে থাকে আন্দোলনের প্রস্তুতি।

সরকার কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করে। এটি পুনর্বহাল চেয়ে ১ জুলাই শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা এক প্লাটফর্মে গঠন করেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। প্রথমদিন থেকেই তাদের সংবাদ প্রচারে গুরুত্ব দেয় যমুনা টেলিভিশন।

৪ জুলাই, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। পরদিন থেকে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি। ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষণা আসে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির, যা ৭ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এই কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে সড়ক ও রেলপথে অবরোধ তৈরি হয়, অচল হয়ে পড়ে জনজীবন।

১৪ জুলাই, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে ঘিরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। তিনি গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন— ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা মেধাবী?’ এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন করে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়।

১৫ জুলাই ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ঢামেকে আহতদের ওপর আবারও হামলা হয়। একই রাতে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের আরেকটি হামলা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। রংপুরে সংঘর্ষে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গুলি করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর পরপরই জনতার ক্ষোভ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ওই রাতেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার, কিন্তু তাতে আন্দোলন থামেনি।

১৭ ও ১৮ জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। ঢাকা শহর তখন রূপ নেয় এক যুদ্ধক্ষেত্রে। সেদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে অন্তত ২৯ জন নিহত হন। সরকারপ্রধান প্রস্তাব দেন ২০ শতাংশ কোটা রাখার, কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সংযোগ।

১৯ জুলাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। হাসপাতালগুলোতে লাশের স্তূপ জমতে থাকে, শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। মেট্রোরেল স্টেশন, এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, নরসিংদীর জেলখানা—সবখানেই সহিংসতা ও প্রতিরোধের চিত্র দেখা যায়। শেষমেশ জারি হয় কারফিউ, সেনাবাহিনী নামে রাস্তায়।

কিন্তু এত কিছুর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। বরং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এটিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। প্রতিবাদের এই ঢেউ থেমে থাকেনি ৩১ জুলাইয়ে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তা এগিয়ে গেছে আরও একদিন। শহীদ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ— সবকিছু মিলিয়ে এক মাস পরিণত হয় এক ঐতিহাসিক ৩৬ দিনে। কারণ জনগণ জানিয়ে দেয়—জুলাই তখনও শেষ হয়নি, যতক্ষণ না বিজয় আসে।

অবশেষে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারের সমাবেশে ঘোষণা আসে—সরকার পতনের এক দফা। ৪ আগস্ট ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি, যা একদিন এগিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয় ৫ আগস্টে এবং সেই দিন—৫ আগস্ট; যা ইতিহাসে লেখা হয় ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে, ছিল দীর্ঘতম প্রতিবাদের বিজয় দিন। লাখো মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়, পথে নামে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে। সেদিন দুপুরের আগেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। শেষ হয় একটি অধ্যায়ের, সূচনা হয় নতুন একটি সময়ের— তারুণ্যের, সাহসের, সমতার ও পরিবর্তনের সময়।

সোর্স: বাংলা ট্রিবিউন

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর