শহীদ এই জেনারেল শুধুমাত্র তার কৌশলগত প্রতিভার জন্যই নয়, মানবতার প্রতি তার সহানুভূতি ও ভক্তির জন্যও প্রশংসিত হয়েছিলেন। কাসেম সোলাইমানি, একজন দক্ষ জেনারেল যিনি বিভিন্ন ধরণের অপারেশন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি নিহত হন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে এক ড্রোন হামলায় বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ সোলাইমানি একজন উচ্চপদস্থ সামরিক জেনারেলের দায়িত্বের মধ্যে একটি সুন্দর, শৈল্পিক সংযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং একজন দৃঢ়চেতা নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন জেনারেল হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি একজন যত্নশীল বাবা ও সদয় বন্ধুও ছিলেন।
ডাউন-টু-আর্থ এবং নম্র
ব্যক্তিগত জীবনে এবং যুদ্ধক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই সোলাইমানি তার আচার-আচরণে বিনয়ী ছিলেন। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হওয়া সত্ত্বেও তার জীবন-যাপন ছিল সাধারণ মানুষের মতোই। অনেক অনুষ্ঠানে যেমন— শহিদ ও তার সহযোদ্ধাদের জানাজায়, শহিদদের পরিবার ও সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার সময়, বক্তৃতা দেওয়ার সময় বা জনসভায়, তিনি কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই হাজির হতেন।
একবার দায়েশকে সফলভাবে পরাজিত করার জন্য আইআরজিসি কুদস বাহিনীকে সম্মান জানাতে আইবিএনএ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল সোলাইমানির। অনুষ্ঠানটি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সম্মান জানানোর বিষয়ে ছিল বুঝতে পেরে জেনারেল সোলাইমানি অনুষ্ঠানে অংশ নেননি এবং পরিবর্তে একজন প্রতিনিধি পাঠান।
যুদ্ধক্ষেত্রে এবং তার সহযোদ্ধাদের মধ্যে জেনারেলের বিনয়ী মনোভাবও প্রকাশ পেয়েছিল। বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্র বা দুই ভাইয়ের সম্পর্কের মতো। সৈন্যরা সামরিক বাহিনীতে থাকার কারণে বাধ্যতামূলক নয়, বরং তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রবণতা থেকে তার আদেশ বেশি অনুসরণ করেছিল। জেনারেলের ডাউন-টু-আর্থ, নম্র আচরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি ছিল যে সবাই তাকে তার প্রথম নামে চিনত এবং তাকে ‘হজ কাসেম’ বলে ডাকত।
মানুষের প্রতি যত্ন ও নিষ্ঠা
যখন তিনি মানুষের সঙ্গে দেখা করতেন তখন সর্বদা তাকে হাসিখুশি ও প্রফুল্ল দেখা যেত। এ জন্য তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছেন। জেনারেল সোলেইমানি দেশের একজন প্রশাসক এবং সিনিয়র সামরিক কমান্ডার হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুব ব্যস্ত থাকতেন। তবুও তিনি জনগণের উদ্বেগ ও অভিযোগ শোনার জন্য সময় দিতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তার কমরেডদের দাফন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং তাদের সান্ত্বনা দিতে তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন।
যুদ্ধে নৈতিকতা অবলম্বন
একটি কঠিন যুদ্ধ এমন একটি জায়গা যেখানে সূক্ষ্ম নৈতিক উদ্বেগগুলোকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় না। সাধারণ নিয়মে যেসব জিনিসগুলোকে সাধারণ পরিস্থিতিতে নিন্দা করা হয় তা সাধারণত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অধিকার লংঘন হিসাবে উল্লেখ করা হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও চারিদিকে বুলেট ও শ্রাপনেলের ছড়াছড়ির মধ্যেও সোলাইমানির ‘নৈতিকতার সচেতনতা’ ছিল একটি অসাধারণ, চিন্তা-উদ্দীপক ঘটনা।
সোলাইমানি তার বাহিনীকে বন্দিদের আক্রমণ করা বা নারী ও শিশুদের সঙ্গে নৃশংস আচরণ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
একবার এক যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যারা এখানে আছি তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে কোনটি জায়েজ এবং কোনটি হারাম। ... আমরা শুধু মানুষের বাড়ি দখল করতে পারি না।" যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিকদের দেহ ও আত্মার কোনো ক্ষতি করা উচিত নয়।
জেনারেল সোলাইমানির ব্যক্তিত্বের রহস্য
জেনারেল সোলেইমানির চরিত্রের প্রতি যে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল তার বহুমাত্রিক অস্তিত্ব এবং ব্যক্তিত্বের বিশালতা। সামরিক বিষয় ও কৌশল বোঝার ক্ষেত্রে তার এমন দক্ষতা ছিল যে তার শত্রুরাও তার সামরিক শক্তি ও ক্ষমতাকে স্বীকার করে।
অন্যদিকে, নৈতিক বিষয়গুলোও তার কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ব্যস্ত মনের মধ্যেও তিনি সেগুলো নিয়ে চিন্তা এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার উপায় খুঁজতেন।
সম্ভবত জেনারেল সোলাইমানির উচ্চাভিলাষী আকাঙক্ষা ও তার সুদূরপ্রসারী, ব্যাপক অস্তিত্ব - তার চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে পাওয়া যায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিশুদ্ধ ইসলামি মতাদর্শে বেড়ে ওঠা একজন মুসলিম হিসেবে জেনারেল সোলাইমানি এই বিশ্বাসে পৌঁছেছিলেন যে মানব জীবন ও অস্তিত্বের ক্ষেত্রটি উপাসনা, প্রার্থনা এবং মহান আল্লাহর জিকিরে মনোযোগ দেওয়ার বিষয়। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের অভিব্যক্তিতে ধৈর্যের সঙ্গে এবং ভালোবাসার সঙ্গে সাড়া দেওয়া, নিপীড়িত, নিরপরাধ এবং অত্যাচারী দায়েশ বা তাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করতে সাহসীভাবে ক্লান্ত হওয়া যাবে না।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খামেনি, জেনারেল সোলাইমানির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, তিনি সব মানুষকে ভালোবাসতেন এবং তিনি সবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এছাড়া তিনি আধ্যাত্মিকতা, বিশুদ্ধতা এবং ধার্মিকতাসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। পাহাড় থেকে মরুভূমি তিনি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরকম শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
মন্তব্য করুন: