[email protected] শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
২৬ আষাঢ় ১৪৩২

টর্চার রুমের নির্যাতন: ওড়না কেড়ে নিয়ে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতো তরুণীদের!

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০ জুলাই ২০২৫ ১৩:০৭ পিএম

ছবি : গ্রাফিক্স

পর্দানশীল তরুণীদের তুলে নিয়ে নির্যাতন চালাত শেখ হাসিনার গুম-খুনের বাহিনী । টর্চার রুমে নিয়ে শরীর থেকে ওড়না কেড়ে নিত। অনেকটা ক্রসিফাইড হওয়ার মতো করে দুই হাত দুই দিকে তুলে বেঁধে রাখত।

এমনভাবে রাখা হতো, যাতে ওই কম্পাউন্ডে পুরুষ অফিসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্য ওড়নাবিহীন অবস্থায় ওই নারীদের দেখতে পায়। ওই সব স্থানে ইসলামবিরোধী মনোভাবাপন্নদের দায়িত্ব দেওয়া হতো। তারা ওই তরুণীদের সামনে দিয়ে হাঁটাহাটি করত আর উপহাস করে বলত‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।’

সম্প্রতি প্রকাশিত গুম কমিশনের প্রতিবেদনে ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় এমন চিত্র উঠে এসেছে। ‘রাষ্ট্রীয় মদতে গুম : নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্মোচন’ শীর্ষক অধ্যায়ে এসব তথ্য তুলে ধরেছে গুম কমিশন। গত ১ জুলাই এ প্রতিবেদন গণমাধ্যমের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

প্রতিবেদনে ‘নারীদের জন্য বিশেষ শাস্তি’ অংশে বলা হয়, ইচ্ছা করে বারবার ওড়নাবিহীন ওই নারীদের দেখার জন্য আসত পুরুষ সদস্যরা। তারা ওই নারীদের দেখে রীতিমতো ‘মজা নেওয়ার মতো’ নোংরা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাত। গুম কমিশনকে দেওয়া বক্তব্যে ভুক্তভোগী নারীরা বলেন, ‘অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতগুলো আসছে দেখার জন্য, এটা বলার বাইরে। মানে তারা একটা মজা পাচ্ছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নারীদের এতটাই টর্চার করা হতো যে, অনেক সময় নির্মম অত্যাচারের ফলে অনেকের পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যেত। নারীত্বের ওই বিশেষ সময়ের জন্য প্যাড চাইলে হাসিঠাট্টা করত। এ সময় ‘আমার তো প্যাড লাগবে’ নারীদের মুখ থেকে বের হওয়া এই অসহায়ত্ব প্রকাশক শব্দগুলো নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত তারা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুমের শিকার নারী-পুরষ নির্বিশেষে সবার ওপরই নির্মম অত্যাচার চালানো হতো। যৌনাঙ্গে দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক। প্রতিবেদনে এক পুরুষকে নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, “তখন ওরা কিল-থাপ্পড় মারে। প্যান্ট খুলে ফেলে। প্যান্ট খোলার পর আমার একটা ‘বিচির’ (অণ্ডকোষ) সঙ্গে ক্লিপ লাগায়। গাড়ির মধ্যে উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থায় যা বুঝলাম, প্রায় ছয়-সাতজন হবে। কথা বলতেছে, এর মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিতে দিতে আমার প্যান্ট অলরেডি খোলা শেষ। খুলে ক্লিপ দিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির মধ্যে খুব চেঁচাচ্ছি... দুই পা সামনের সিটে লাফানোর কারণে প্রায় এক ফুট করে ছিলে যায়। কিন্তু সেটার ব্যথা কিছু মনে হয়নি। কারেন্ট শকের ব্যথা এতটা ভয়ঙ্কর ছিল।”

ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আরো বলেন, ‘প্রায় ১৫-২০ মিনিট শক দিল। এই ২০ মিনিটে গাড়ি চলতেছিল... এরকম করতে করতে যখন থামল, মনে হলো যে দুনিয়া আর দুনিয়া নেই। শক বন্ধ করার পর প্রায় তিন মিনিট ধরে আমি চেঁচিয়েছি ওই বৈদ্যুতিক শকের কষ্টে। শেষে বাধ্য হয়ে ওরা আমার মুখ চেপে ধরে।’

ঘূর্ণায়মান চেয়ারের মাধ্যমে নির্যাতন প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘নির্যাতনের বিশেষ ধরনের এ যন্ত্র র‌্যাবে টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল ও ডিজিএফআইয়ের জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) ব্যবহার করা হতো। এই চেয়ারে ভুক্তভোগীদের এতটাই উচ্চগতিতে ঘোরানো হতো যে, এর ফলে অনেকেই বমি করতেন, প্রস্রাব ও পায়খানা করে ফেলতেন, এমনকি কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতেন।’

ডিজিএফআইয়ের এরকম নির্যাতনযন্ত্রের বিষয়ে ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় বলা হয়, ‘ওই মেশিনে উঠিয়ে মাথা, হাত, পা ও হাঁটুর মাঝখান বরাবর এবং পায়ের নিচে বাঁধা হতো। ওই মেশিনে উঠিয়ে চালানোর পর মনে হয়েছে, আমার হাড় যেন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কেন বলতে পারব না, ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজাব।’

ওরা বলে, ‘তুমি পিঠ একেবারে লাগাইয়া রাখো। এখানে উঠলে কিন্তু সব পায়খানা করে দেয়। মানে এমন কঠিন অবস্থা ওখানে। মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। এরপর ওখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর ওপর বাড়ি দিয়েছে। তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কী কী ষড়যন্ত্র করতেছ?-এমন প্রশ্ন করে একপর্যায়ে তারা জোরে অণ্ডকোষে চাপ দেয়, আমার শক্তি শেষ হয়ে যায়’-ভুক্তভোগীর বর্ণনায় এভাবেই উঠে আসে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব ও ডিজিএফআই দিয়ে গুম করানো হতো। প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা এমন উপাদান সংগ্রহ করেছি, যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। নির্যাতনের বিভিন্ন কায়দা-কানুনের মধ্যে আরো ছিল টিএফআই সেলে মানুষ ঝুলিয়ে এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা, যাতে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ না শুনতে পারে, সেজন্য ব্যবহৃত হতো।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুম হওয়াদের রাখা হতো শব্দনিরোধক স্থানে। এর ফলে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে পেত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত।

নির্যাতনের কারণে ভুক্তভোগীদের শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষত মুছতে ওই স্থানে দেওয়া হতো মলম। জনসম্মুক্ষে আনার পর ক্ষত বা নির্যাতনের চিহ্ন যেন দেখা না যায়, সেজন্যই মলম লাগানো হতো। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তবেই মুক্তি দেওয়া হতো। তবে অনেক ভুক্তভোগী আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন দেখালেও সেসব অভিযোগ উপেক্ষা করা হয়। 

সোর্স: আমার দেশ 

 

 

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর