গত ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের ভয়াবহ স্মৃতি দগদগে থাকার পরও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা- সর্বোপরি হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুকে অস্বীকার করা, কোনোক্রমেই সুস্থতার লক্ষণ না।
শেখ হাসিনার শাসনামল বিশ্বব্যাপী স্বৈরাচারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাষ্ট্র থেকে আইনের শাসন উচ্ছেদ করে দল এবং ব্যক্তির স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে নিজেকে তিনি ক্রমাগত ফ্যাসিবাদের আইকনে পরিণত করেছেন। নির্বাচনকে কীভাবে জালিয়াতিপূর্ণ করা যায়, কীভাবে প্রতারণাপূর্ণ করা যায়, কীভাবে সংবিধানকে পায়ের তলায় পিষে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া যায়- সেসব চর্চায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দলগত স্বার্থে ব্যবহারের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ছিলেন বিরল। প্রশাসনকে দলীয়করণ, পুলিশকে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণতকরণ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে ভিন্নমত দমনের নামে নিষ্ঠুর সংস্থায় উন্নীতকরণ এবং সেনাবাহিনীকে জাতীয় প্রতিরক্ষার শৌর্য-বীর্য থেকে পুলিশের ভূমিকায় স্থানান্তর করার অপরিমেয় কৌশল, রাষ্ট্রকে কী পরিমাণ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে, তা কল্পনাতীত।
গত ১৫ বছর ভিন্ন মত-পথকে দমন করার জন্য, বিরোধী দলের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং গায়েবি মামলা দেয়ার অসামান্য দক্ষতা ছিল শেখ হাসিনার। একজন নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার, প্রতিপক্ষকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার ঘৃণ্য প্রবণতা, নিজের সমস্ত অপকর্মকে ‘গৌরব’ হিসেবে উপস্থাপন করার আশ্চর্যজনক প্রাণশক্তি ছিল তার। সত্য, নীতি-নৈতিকতা, জনগণ এবং আইন সব কিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাটাকে ‘মহান’ মনে করতেন। তার শাসনামলের গতি-প্রকৃতি, প্রবণতা, সর্বোপরি সারমর্ম ছিল ভয়ঙ্কর। ক্ষমতার জন্য যারা হুমকি- তাদেরকে হত্যা, কারারুদ্ধ, রিমান্ডে নির্যাতন, আয়নাঘরের অধিবাসী করা ছিল তার মনোজগতের সান্ত্বনা।
রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে মানুষ খুন হচ্ছে অথচ শেখ হাসিনা স্বীকার করছে না! এতো এতো মৃত্যু, এতো হাহাকার, এতো তাজা রক্তের তরঙ্গ চোখের সামনে ঘটেছে অথচ শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অন্ধ-অনুসারীরা তা পাইকারিভাবে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, দেশের নাগরিক হত্যাকে সামগ্রিকভাবে তুচ্ছ করে দিচ্ছে। পুলিশের গুলিতে কতো বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, মাথার খুলি উড়ে গেছে, পাঁজর ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে, শ্যামল মাটি রক্তে লালবর্ণ ধারণ করেছে অথচ বেমালুম অস্বীকার করে যাচ্ছে। ন্যূনতম অনুশোচনাও নেই। যৌক্তিকতার বিরোধিতা করতে হলেও একটি যুক্তি থাকতে হয়। শেখ হাসিনা তার সরকারের আমলে অন্যায়-অপরাধ কিংবা গণহত্যা- কোনো কিছুকেই যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি মনে করেননি। এই অস্বীকারের মধ্যদিয়ে, সত্যকে ভ্রুকুটি দেখানোর মধ্যদিয়ে, ন্যায্যতাকে পিষ্ট করার মধ্যদিয়ে, তার কোনো মানবিক আবেগ বা মনস্তাত্ত্বিক আচরণ প্রকাশ পায় না। নিষ্ঠুরতার প্রতি আনুকূল্য, সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের প্রতি সহমর্মিতা, ক্ষমতা প্রয়োগে কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণকে সর্বদাই যৌক্তিক মনে করেছেন, কু-যুক্তিকেই যুক্তির ওপর প্রতিস্থাপন করেছেন তিনি। মৃত্যুকে মৃত্যু মনে না করা, হত্যাকে অনুভূতির সঙ্গে বিশ্লেষণ না করা, অহরহ মিথ্যা বয়ানকে ক্ষমতাবান মনে করার মতো ভয়াবহ অন্যায়ে তিনি এবং আওয়ামী লীগ জড়িত। গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত একটি দল, নিষ্ঠুরতার প্রতীকে প্রতিকায়িত একটি দল, নৌকা বোঝাই করা লাশের অপরাধে অপরাধকৃত একটি দল, গণ-অভ্যুত্থানে ও জনরোষে পলায়নপর একটি দলের সভানেত্রীর কোনো অনুতাপ নেই, কোনো আত্ম-জিজ্ঞাসা নেই, কোনো আত্ম-সমালোচনা নেই- মানব সমাজে এটা বিরল দৃষ্টান্ত। এখনো যুদ্ধংদেহী, বিদ্বেষী মনোভাব, কথার বাণ নিক্ষেপ, তাঁবেদারিত্বের প্রবণতা, আওয়ামী লেন্সের ব্যবহার- বিশ্ব রাজনীতিতে বড়ো বিস্ময়কর।
শেখ হাসিনা জন্মসূত্রে এ দেশের নাগরিক। পরিবার, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও জন্মগত যোগসূত্রে বাংলাদেশি তো বটেই, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও তিনি। অথচ ভারতে বাংলাদেশি দূতাবাসে হামলা হচ্ছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, দেশের বিরুদ্ধে অহরহ মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, দেশের স্থিতিশীলতাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে দিচ্ছে কিন্তু এসব নিয়ে টুঁ-শব্দটিও উচ্চারণ করে না আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বা শেখ হাসিনা। যে প্রতিবেশী শত্রুর মতো আচরণ করছে, শত্রুভাবাপন্ন করে তুলছে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, সামপ্রদায়িক দাঙ্গার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে আকৃষ্ট ও আগ্রহী হয়ে উঠছে, সেদেশে বসেই শেখ হাসিনা তাদেরই প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করছে। প্রভুর প্রতি শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা অসাধারণ।
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এখন তারা কোনো জাতীয় চেতনা অনুভব করে না, রাষ্ট্র নিয়ে গৌরব অনুভব করে না, দেশপ্রেম-স্বজাতপ্রেম তাদের আর জাগ্রত করে না।
এতে বুঝা যায় দেশের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, জনগণের প্রতি আওয়ামী লীগের কোনো দায় নেই, শ্রদ্ধা নেই, ভালোবাসা নেই।
১৯৭১ সালে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হয়েছিল। অথচ ৫৩ বছর পর ‘৭১-এর ‘গণহত্যার’ পুনরাবৃত্তি ঘটলো শেখ হাসিনার হাতে। পাকিস্তানিরা গণহত্যার কথা স্বীকার করে কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করে, আর শেখ হাসিনা গণহত্যাকে অস্বীকার করে। ফলে এতো রক্তাক্ত ফলাফল, রক্তাক্ত পরিণতি, ভয়ানক দুর্দশা- কোনোটাই শেখ হাসিনার ভেতরের বিচারালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
এতো নারী-শিশু হত্যা, অঙ্গ হানির যাতনা, অসংখ্য দৃষ্টিশক্তিহীনতা, অগণিত মায়ের আহাজারি- শেখ হাসিনার বিবেক স্পর্শ করতে পারেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে, মৌলিক অধিকারের দাবিতে যারা সংগ্রামরত, তাদেরকে অপশক্তি, সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, নির্মমভাবে হত্যা করাকে বৈধ মনে করার নোংরা রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ এক ইঞ্চিও সরে দাঁড়ায়নি। চেচেন গেরিলাদের হত্যা করার সময় রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন বলেছিলেন- ‘পাগলা কুকুরকে গুলি করে মারতেই হয়।’ সেই বিশ্বাস থেকেই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করার পরও স্থাপনার জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন, এটাকেই শেখ হাসিনা এখনো যুক্তিসঙ্গত মনে করেন। দেশের মানুষকে শত্রু মনে করা, কাল্পনিক ট্যাগ লাগিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষের বিস্তার করা, মানবিক ও নৈতিক সংস্কৃতিকে তছনছ করা, সত্য এবং ন্যায়কে বিসর্জন দেয়ার- আওয়ামী লীগের এই ভয়াবহ মানসিকতা অ-মেরামত যোগ্য। নিজ ভূমি ছেড়ে, নিজ দল ছেড়ে, রাষ্ট্রহীন, পাসপোর্টহীন, নাগরিকত্বহীন হয়ে ভারতে বহিরাগত হিসেবে থেকেও ন্যায্যতা উপলব্ধির কোনো তাগিদ শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরে প্রকাশ হয় না, ন্যায্যতা নির্ধারণের পক্ষে এমন কোনো মূল্যবোধ বা আদর্শ প্রকাশ্যে আসে না।
এখন আর এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৈতিক শক্তি বিলীন হয়ে গেছে। রলস বলেছিলেন- নৈতিক শক্তির দু’টি প্রধান অঙ্গ হচ্ছে ‘ন্যায্যতা উপলব্ধির সামর্থ্য’ এবং ‘শুভচিন্তার সামর্থ্য’। ৫ই আগস্টের পর দলের একজন বিবেকবান নেতা বা কর্মীও প্রশ্ন উত্থাপন করেননি- নির্বাচনবিহীন, জনগণের সম্মতিবিহীন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গণহত্যার দায় আওয়ামী লীগ বহন করবে কেন? গণহত্যার দায় মাথায় নিয়ে এখনো শেখ হাসিনা দলীয় সভানেত্রীর পদ কীভাবে আঁকড়ে আছেন?
বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে থেকেই প্রাণ দিয়েছেন, পরিণতি মেনে নিয়েছেন, এই দেশের মাটিতেই শায়িত আছেন। ’৭১ সালের ২৫শে মার্চেও বাড়ির পেছন দিক দিয়ে তিনি পালাতে চাননি। অথচ বঙ্গবন্ধুর কন্যা হয়ে দিন-দুপুরে তীব্র সূর্যের আলোর নিচে হেলিকপ্টারে পলায়ন করেছেন, দেশ ও রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে। একদিন তিনি অহংকারের সীমাহীন উচ্চতায় বলেছিলেন- আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কে? কিন্তু তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন, দেশপ্রেম বড় নয়, দেশ পরিত্যাগ করাই বড়। নিজের চোখের সামনে দেখলেন- গণতন্ত্রের জন্য মৃত্যুবরণ করাই বড়, বেঁচে থাকা বড় নয়। ছাত্র-জনতা প্রমাণ করেছে, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে না থাকার চেয়ে মৃত্যুকে বরণ করাই বরং বেঁচে থাকার নামান্তর। লজ্জাজনক বেঁচে থাকার চেয়ে লড়াইয়ের ময়দানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করাই জীবনের হিরণ্ময় সৌন্দর্যের তৃপ্তি।
যিনি দেশের কথা দূরে থাক, দলের মানুষদের বিপদে ফেলে নিজের ফ্যামিলির সবাইকে একে একে বিদেশে পাঠিয়ে শেষের দিন আপন বোন এবং আত্মীয় নিয়ে বিমানযোগে নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন, সেই তিনি এখন ফোনে যোগাযোগ করছেন, আত্মগোপনে থেকে বক্তব্য দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা জানেন- ভারতের মাটিতে তাকে আত্মগোপনে থাকতে হবে, সহসা তিনি বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের সভা আহ্বান করতে পারবেন না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। দলের একটা লোভনীয় পদ ৪৪ বছর যাবৎ ধরে রেখে দলেরই সর্বনাশ করে কবর রচনা করে দিয়েছেন; অথচ দল কোনো প্রকার প্রশ্ন উত্থাপন করছে না। ‘শেখ হাসিনা পালায় না’- এই দম্ভোক্তি চুরমার হয়ে যাওয়ার পরও কেউ প্রশ্ন করছে না, আপনি পালালেন কেন? যে অঙ্গীকার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়া উচিত, সে অঙ্গীকার থেকে একদিন পরই সরে গেছেন তিনি। কোনো বীর অঙ্গীকার থেকে সরে না- ভীরু সরে যায়। আওয়ামী লীগে এমন একজন মানুষ নেই, যিনি শেখ হাসিনার ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এতো ‘অধীন’ এবং ‘অধীনস্থ’ থাকাকেই যদি আওয়ামী লীগ প্রাধান্য দেয়, অন্ধ এবং অজ্ঞানতার আস্তরণের আড়ালে যদি চাপা পড়ে থাকে, তাহলে দল হিসেবে সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।
ইতিহাসের গতিধারাকে বুঝতে অক্ষম
শেখ হাসিনা, রাষ্ট্র এবং দল- সকল ক্ষেত্রেই স্বৈরাচার। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ শেখ হাসিনার পতনকে আনন্দ সহকারে উদ্যাপন করেছে অথচ তিনি এখনো রাষ্ট্র নিয়ে চক্রান্ত করেন- বিবেকের কোনো দংশন ছাড়াই। তিনি এখনো ডক্টর ইউনূসকে হুমকি দিয়ে বেড়ান। অনেক আগেই তিনি প্রমাণ করেছেন, রাষ্ট্র এবং জনগণের সম্পর্ক হবে শিকার এবং শিকারির। জুলাই হত্যাকাণ্ড, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, ক্রসফায়ার কোনো কিছুই শেখ হাসিনাকে আহত করে না, ব্যথিত করে না। শেখ হাসিনার ন্যায্যতা বিচারের ভিতটা ধসে গেছে। তার পক্ষে আর ন্যায্যতা অন্বেষণ করা সম্ভব হবে না।
শেখ হাসিনাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না বরং সংশোধন অযোগ্য শেখ হাসিনাকে ‘চিরকালের স্বৈরাচারী’ হিসেবে চিহ্নিত করবে।
মন্তব্য করুন: