রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩৮৫টি ট্রেন চালানোর কথা থাকলেও বাস্তবে চলছে মাত্র ২৮৬টি।
গত দশকে বাংলাদেশের জিডিপি ৪০ লক্ষ কোটি টাকা বাড়লেও এবং বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলেও, দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে বাংলাদেশ রেলওয়ে এ অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ সময়ে রেল খাতে ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করা হলেও, এর পরিষেবা সক্ষমতা অনুপাতে বাড়েনি। বরং, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি প্রতি বছর ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হলেও ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি, যদিও এসব রুটে প্রচণ্ড চাহিদা রয়েছে বলে রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "বছরের পর বছর রেলওয়ে উন্নয়নের অর্থ মূলত ট্র্যাক নির্মাণেই ব্যয় হয়েছে, কিন্তু লোকোমোটিভ বা কোচ কেনায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়নি। এখন আমরা সে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছি।"
গত এক দশকে রেলওয়ে মাত্র ২২ জোড়া নতুন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করেছে, যা কেবল ৩১,০০০ নতুন যাত্রীর যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করেছে। স্বল্প দূরত্বের জন্য ১০টিরও বেশি নতুন কমিউটার ট্রেন চালু করা হলেও, ৫০টিরও বেশি পুরনো ট্রেন—যার কিছু অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলছিল—পরিচালনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ফলে জনপ্রিয় ও লাভজনক পরিষেবা প্রদানকারী হয়ে ওঠার রেলওয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দুর্বল পরিকল্পনা, কার্যকর ফলাফলের অভাব
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভুল বিনিয়োগের কারণে রেলওয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারেনি।
"রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মুখে মুখে সুন্দর সুন্দর উপযোগিতার কথা বলত। কিন্তু তারা জানত যে নতুন ট্র্যাক থাকলেও কোচ ও ইঞ্জিনের অভাবে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে না," বলেন বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক।
"তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এজন্য নিজেরাই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন," তিনি আরও বলেন।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির মোট পরিচালন ব্যয় ছিল ৩,৩০৭ কোটি টাকা, যেখানে রাজস্ব আয় ১,৭৮৩ কোটি টাকা। এতে ১,৫০০ কোটিরও বেশি টাকা লোকসান হয়েছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেলওয়ের সক্ষমতা দ্বিগুণ করা গেলে রাজস্ব ৩,৬৫০ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, "শুধু যাত্রী পরিবহন রেলওয়ের জন্য লাভজনক নয়। লোকসান কমিয়ে লাভের দিকে যেতে পরিষেবার মানোন্নয়ন, মালবাহী পরিবহনের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ার্কশপ আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।"
ইঞ্জিন, কোচ, জনবল সংকটে বিপর্যস্ত রেলওয়ে
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩৮৫টি ট্রেন চালানোর কথা থাকলেও বাস্তবে চলছে মাত্র ২৮৬টি। ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে ৯৯টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে—এর মধ্যে ৫০টি পূর্বাঞ্চলে ও ৪৯টি পশ্চিমাঞ্চলে।
এ ছাড়া, চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড থেকে জ্বালানি তেল, পাথর, খাদ্যশস্য ও শিল্প কাঁচামাল পরিবহনের জন্য ১৫টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন হলেও মাত্র সাতটি ইঞ্জিন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
কন্টেইনার ট্রেনের জন্য সাতটি ইঞ্জিন দরকার থাকলেও মাত্র দুটি ইঞ্জিন চালু রয়েছে, ফলে পণ্য পরিবহন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
রেলওয়ের পরিবহন ও যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, সব ট্রেন চালাতে অন্তত ৩,০০০ কোচ ও ৩০০ লোকোমোটিভ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে রেলওয়েতে আছে ২,৫০০ কোচ ও ৩০০ লোকোমোটিভের কিছু বেশি, যার সবগুলো কার্যকর নয়।
৫০ শতাংশেরও বেশি ইঞ্জিন ও কোচ কার্যকর মেয়াদ হারিয়েছে। বর্তমানে কার্যকর অবস্থায় আছে মাত্র ২,০০০ কোচ ও ২০০-এর কিছু বেশি লোকোমোটিভ।
পূর্বাঞ্চলে ১,১৩১টি কোচ ও ৭৫টি লোকোমোটিভ সক্রিয় থাকলেও সব ট্রেন পুনরায় চালু করতে অন্তত ১১৬টি লোকোমোটিভ ও ১,৫০০ কোচ প্রয়োজন বলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে ৮৯০টি কার্যকর কোচ ও ১৫৩টি লোকোমোটিভ।
পশ্চিমাঞ্চলেও তীব্র জনবল সংকট দেখা দিয়েছে। অনুমোদিত ৪৭,০০০ পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ২৩,০০০ কর্মী।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "সমস্ত রুট ব্রডগেজে রূপান্তরের পরিকল্পনা ছিল, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, যা সম্পন্ন হতে ২৫-৩০ বছর লাগবে।
"একটি কোরিয়ান কোম্পানি পুরনো লোকোমোটিভ মেরামত ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহের আগ্রহ দেখিয়েছে। বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনাধীন।"
রেলওয়ের রাজস্ব বৃদ্ধির উপায়
সম্প্রতি, রেলওয়ের প্রধান অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্বাঞ্চল) মো. শহীদুল ইসলাম এক প্রতিবেদনে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাব্য উপায় তুলে ধরেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ টিকিট বিক্রি করে। তবে, অনলাইন টিকিটিং সার্ভারের ট্র্যাফিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী প্রকৃত চাহিদা কমপক্ষে ২০ লাখ।
রেলওয়ের সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে—প্রতিদিন ৪ লাখ টিকিট বিক্রির লক্ষ্যে—অতিরিক্ত ১,৩০০ কোচ, ২০০ লোকোমোটিভ এবং ১,৫০০ কর্মী প্রয়োজন হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে রেলওয়ের বার্ষিক রাজস্ব ৩,৬৫০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে।
প্রতিবেদনে যাত্রীসেবা উন্নয়ন ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর কোচ সংখ্যা ১৪ থেকে ১৮-তে উন্নীত করা, যা ২৫% রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারে। এজন্য ৩২৩টি অতিরিক্ত কোচ প্রয়োজন, যা বছরে আনুমানিক ২৬১ কোটি টাকা আয় করবে।
এছাড়া, বৃহস্পতি ও শনিবার যাত্রী চাহিদা বেশি থাকায় ওই দিনগুলোতে ৩০ জোড়া ট্রেনে দুটি অতিরিক্ত কোচ সংযোজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে বার্ষিক রাজস্ব ৪৫ কোটি টাকা বাড়তে পারে। তবে এর জন্য ৭৫টি নতুন কোচ লাগবে।
প্রতিবেদনে ঈদ, পূজা ও অন্যান্য উচ্চ-চাহিদাসম্পন্ন দিবস উপলক্ষে ২০টি বিশেষ ট্রেন চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বছরে ১২০ কোটি টাকা আয় হতে পারে। এর জন্য ৪৫০টি নতুন কোচ প্রয়োজন হবে।
রেলওয়ে মালবাহী পরিবহনের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির বড় সুযোগ তৈরি করতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কন্টেইনার পরিবহনের মাত্র ২% বর্তমানে রেলপথে হয়, যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ এ হার ২৫%-এ উন্নীত করতে চায়। তবে কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোর (আইসিডি) বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে এটি সম্ভব নয়।
বর্ধিত চাহিদা সামাল দিতে ধীরাশ্রম আইসিডি প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এছাড়া, ৪০টি নতুন মিটারগেজ লোকোমোটিভ ও ৪৫০ জন অতিরিক্ত কর্মী—গার্ড, লোকোমোটিভ মাস্টার, সহকারী লোকোমোটিভ মাস্টার এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্য—নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বছরে ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব আসতে পারে।
পদ্মা সেতুর কাছে নিমতলা স্টেশনে নবনির্মিত আইসিডি মংলা বন্দর থেকে ২ লাখ টিইইউ কন্টেইনার পরিবহনের সুযোগ তৈরি করবে, যা বছরে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা আয় করতে পারে।
বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, "শুধু যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে রেলওয়ে লাভজনক হতে পারবে না। মালবাহী পরিবহন থেকে মুনাফা অর্জন করতে হবে এবং সে রাজস্ব যাত্রী পরিষেবায় ভর্তুকি দিতে হবে।"
রেলওয়ে আপগ্রেডের জন্য ৩০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন
রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান রেলপথে অতিরিক্ত ট্রেন পরিচালনা সম্ভব, তবে কমলাপুর স্টেশনে আরও প্ল্যাটফর্ম দরকার। পাশাপাশি, বিদ্যমান ওয়ার্কশপগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং নতুন ওয়ার্কশপ নির্মাণ করতে হবে। সব মিলিয়ে, এসব উন্নয়নের জন্য প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রেলওয়ের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পূর্বাঞ্চল) মো. শহীদুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "বর্তমানে ১১২টি আন্তঃনগর ট্রেন চালু আছে। এটি ৩৫০-এ উন্নীত করা গেলে, যাত্রী আয় ৪,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে, আর দৈনিক টিকিট বিক্রি হবে ৬ লাখ।
"এর জন্য ৩,০০০ অতিরিক্ত কোচ, ২০০ লোকোমোটিভ এবং ১,৫০০ জন কর্মী প্রয়োজন হবে, যার ফলে রেলওয়ের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য অনেকটা সমান হবে।"
সোর্স: The Business Standard
মন্তব্য করুন: