যে দেশে ঋণখেলাপির ছড়াছড়ি, সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম মোস্তফা কামাল। গত ১৫ বছরে তিনি ৪০টিরও বেশি শিল্প ইউনিট গড়ে তুলেছেন, কিন্তু কখনও খেলাপি হননি।
১৯৭৬ সালে ছোট পরিসরে উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তরুণ মোস্তফা কামাল। পুঁজি ছিল মাত্র ৬৫০ টাকা। এই পুঁজির সিংহভাগই এসেছিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কনকাপৈত গ্রামের পারিবারিক জমি বিক্রি করে। সেই টাকা দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কামাল ট্রেডিং কোম্পানি।
তবে মোস্তফা কামালের এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। এমনকি তার বাবাও সংশয় চাপতে না পেরে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসেছিলেন—'তুমি ব্যবসা করতে পারবে তো?'
কামালের বাবা মারা যান ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ততদিনে তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিলেন। কামাল ততদিনে একটি কর্পোরেট সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে ফেলেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি একটি উদ্ভিজ্জ তেল কারখানা চালু করেন, ১৯৯৩ সালে 'ফ্রেশ' ব্র্যান্ডের আওতায় দুগ্ধজাত এবং খাদ্যপণ্য বাজারজাত শুরু করেন। এই ব্র্যান্ড এখন জনপ্রিয় নাম।
'ফ্রেশ-এর নাম আজ ঘরে ঘরে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রতি দুই পরিবারের একটিতে ব্যবহার হয় ফ্রেশের পণ্য, নিজের সুপরিসর অফিসে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন কামাল।
কামাল প্রতিনিয়ত ব্যবসা সম্প্রসারণের তাগিদ অনুভব করেছেন। ১৯৮৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তিনি মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর (এমজিআই) ব্যানারে আরও আটটি কারখানা স্থাপন করেন। তবে তার ব্যবসার মোড় ঘুরে যায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে, দুটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার লাইসেন্স পাওয়ার পর। এর মাধ্যমেই তার ব্যবসার অসাধারণ প্রবৃদ্ধির সূচনা হয়।
২০১৮ সালে কামাল আটটি শিল্প ইউনিট স্থাপন করেন, ২০২০ সালে স্থাপন করেন আরও নয়টি ইউনিট। এখন এমজিআইয়ের অধীনে ৫৪টি শিল্প ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটে সরাসরি ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করেন। আর এসব ইউনিটের বার্ষিক টার্নওভার আয় ৩ বিলিয়ন ডলার বা ৩৬ হাজার কোটি টাকা—যা আইকনিক পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি।
অসাধারণ সাফল্য অর্জন করলেও কামালের এই যাত্রা কিন্তু মসৃণ ছিল না।
১৯৮৯ সালে প্রথম শিল্প ইউনিট মেঘনা ভেজিটেবল অয়েল মিল প্রতিষ্ঠার সময় ব্যাংক থেকে ঋণ চেয়ে বারবার প্রত্যাখ্যানই জোটে তার ভাগ্যে। শেষে বাংলাদেশ ও সৌদি সরকারের যৌথ উদ্যোগে গঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবিনকো সহায়তায় এগিয়ে আসে। সাবিনকো তৎকালীন চেয়ারম্যান খোরশেদ আলমের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন কামাল। খোরশেদ আলম পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিলেন।
আজ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো কামালকে ঋণ দেওয়ার জন্য বসে থাকে। তবে কামাল জানালেন, তিনি বিদেশি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলোর সুদহার যেমন তুলনামূলক কম, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দেয়—যা তার বিশাল আমদানি কার্যক্রমের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ঝুঁকি নিয়ে সংকটকে সুযোগে পরিণত করেছেন
কামাল ট্রেডিং কোম্পানির সাদামাটা শুরু থেকে আজকের বিশাল শিল্প-সাম্রাজ্য মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ—মোস্তফা কামালের এই যাত্রা দৃঢ়তা, দূরদৃষ্টি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার নজির। সংকট ও প্রতিবন্ধকতাকে সুযোগে পরিণত করার ক্ষমতা কেবল তার ভাগ্যের মোড়ই ঘোরায়নি, মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজকেও বাংলাদেশের শিল্প খাতে জায়ান্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, করোনা মহামারির সময় অধিকাংশ ব্যবসা যখন টিকে থাকার লড়াই করছিল, তখন মোস্তফা কামাল সুযোগটি কাজে লাগান। বাজারদর নিম্নমুখী থাকার সুবিধা নিয়ে তিনি মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলারে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ কেনেন।
আজ সেই জাহাজগুলোর মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৬০ মিলিয়ন ডলার—আর হয়ে উঠেছে তার দর্শনের জলজ্যান্ত প্রমাণ: 'যেখানে সংকট থাকে, সেখানে থাকে সুযোগও।'
'আপনার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস থাকতে হবে,' বলেন কামাল
তবে জামাল এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। তার ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষুধা আজও অপ্রতিরোধ্য। ২০২২ সালে তিনি তৃতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের লাইসেন্স পান, পরের বছর চতুর্থ অঞ্চলের প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স পান।
বর্তমানে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের (৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) চারটি বৃহৎ শিল্প ইউনিট পাইপলাইনে রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সবুজ ইস্পাত কারখানা। এ প্রকল্প ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশন (আইএফসি) থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পেয়েছে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে আইএফসির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এটি।
এছাড়াও পাইপলাইনে রয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি পেপার মিল এবং ২০০ মিলিয়ন ডলারের গ্লাস ফ্যাক্টরি। দুটি কারখানাই ২০২৫ সালের শুরুর দিকেই উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। এসব প্রকল্পের পূর্তকাজে কামাল ইতিমধ্যে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (২৫০ মিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ করেছেন, যার বড় অংশ এসেছে ব্যাংকঋণ থেকে।
তবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পেতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু দেরিতে সম্পন্ন হতে পারে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ পেতে এই বিলম্ব বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে কাজ করার চ্যালেঞ্জই যেন সামনে নিয়ে আসে।
ভবিষ্যতে চোখ
জ্বালানি ও লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কামাল তার লক্ষ্যে অটল। পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট ও বোর্ড পেপার মিলে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন তিনি। এছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যেও সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এ র অংশ হিসেবে বিনিয়োগ করেছেন সৌরশক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজ জ্বালানি প্রকল্প এবং রিসাইকেল উদ্যোগে।
২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারি মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কামাল টেকসই শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
কৌশলে এড়িয়েছেন ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি
যে দেশে ঋণখেলাপির ছড়াছড়ি—বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে—সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম মোস্তফা কামাল। গত ১৫ বছরে তিনি ৪০টিরও বেশি শিল্প ইউনিট গড়ে তুলেছেন, কিন্তু একবারও ঋণখেলাপি হননি।
তার ব্যবসায়িক রেকর্ডে একমাত্র দাগটি পড়ে ১৯৮৩-৮৪ সালে। ওই সময় চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কারণে আমদানি করা পাম তেলের একটি চালান সময়মতো খালাস করা যায়নি। এতে ওই তেল নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ওই পণ্য অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হওয়ায় ঋণখেলাপি হন কামাল—তবে নিজের ভুলে তিনি খেলাপি হননি।
১৯৯৩-৯৪ এবং ১৯৯৮ সালের দেশীয় সংকট কিংবা ২০০৬-০৭ সালের বৈশ্বিক অস্থিরতার সময়ও কামাল দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কামাল তার ঋণসীমা বাড়িয়েছেন, ঋণ পরিশোধের সময়ও বাড়িয়ে নিয়েছেন—কিন্তু সব ঋণই সম্পূর্ণ পরিশোধ করেছেন।
২০২২ ও ২০২৩ সালে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হলেও সেই ক্ষতি ব্যালান্স শিটে না দেখিয়ে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ক্ষতি কাটিয়ে উঠে তিনি খেলাপি হওয়া ঠেকিয়েছেন।
নিরলস নেতৃত্ব
৭০ বছর বয়সে এসেও কামালের কর্মস্পৃহা অটুট। প্রতি শুক্রবার তিনি নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার কারখানাগুলো পরিদর্শন করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারখানার প্রতিটি কোণ ঘুরে দেখেন, উৎপাদন কার্যক্রম তদারকি করেন। গত ৪০ বছরে বিদেশ সফর ছাড়া তিনি কখনও এই রুটিনের ব্যতিক্রম করেননি।
নিজের কঠোর পরিশ্রমের এই তাড়না তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের চার সন্তানের মধ্যেও। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে পশ্চিমা দেশে পড়াশোনা শেষ করেও দেশে ফিরে এসে বাবার গড়া সাম্রাজ্যকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
আজ মোস্তফা কামাল যখন তার অসাধারণ যাত্রার কথা ভাবেন, তখন দেখেন বাবার সেই প্রথম প্রশ্নের ('তুমি ব্যবসা করতে পারবে তো?') উত্তর তিনি দারুণভাবেই দিতে পেরেছেন।
মন্তব্য করুন: