ajbarta24@gmail.com শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা আস্থা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:০১ পিএম

ছবি সংগৃহীত

দেশে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রূপান্তরকাল চলমান। এখন পর্যন্ত কমেনি মূল্যস্ফীতি। নিরবচ্ছিন্ন হয়নি উৎপাদন ব্যবস্থাও। ঋণের সুদহার বেড়েছে। কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ, অক্টোবরেও যা ছিল গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিদেশী বিনিয়োগও কমেছে ৮ শতাংশের বেশি। তাই দ্রুত আস্থা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ চান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

এদিকে সংস্কার কার্যক্রম চলমান। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে অনাস্থার পরিবেশ বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব অবাধ, স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে এসে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আজ শুরু হওয়া নতুন বছরে এ রকমই তাদের প্রত্যাশা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২৪ সালটাকে তারা বড় চ্যালেঞ্জের বছর হিসেবে পার করেছেন। এখন প্রত্যাশা দেশ মসৃণভাবে চলবে। আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সামগ্রিকভাবে এমন একটা পরিবেশ যেখানে সাধারণ মানুষের স্বস্তি থাকবে, পাশাপাশি শিল্প থেকে শুরু করে দেশের স্বাভাবিক যে কাজকর্ম তা অব্যাহত থাকবে। সর্বোপরি ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের আস্থা। কারণ আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাট একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।

গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গুটিকয়েকজনের দুর্নীতির কারণে গোটা ব্যবসায়ী সমাজকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার-বিবেচনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ শিল্পোদ্যোক্তাদের। তারা বলছেন, দেশে ব্যবসায়ী সমাজের বড় অবদান রয়েছে। এ দেশেই তারা ছোট থেকে বড় হয়েছেন। দেশের মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার কারণেই নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পেরেছেন। কাজেই বিশ্বাস ও সম্মানের জায়গাটা যেন থাকে সেটাই নতুন বছরের প্রত্যাশা। স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এমন একটা পরিবেশ প্রয়োজন, যেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা থাকে। বিশেষ করে ছাত্র থেকে শুরু করে পুরো তরুণ প্রজন্ম যেন দেশের ওপর একটা বিশ্বাস রাখে। কথায় কথায় তারা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কথা ভাবেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য অবশ্যই তারা যেতে পারেন, কিন্তু তারা যেন দেশে ফিরে আসেন সেটা আমরা চাই। তারা যেন মনে করতে পারেন যে দেশে অপার সম্ভাবনা আছে। তাদেরকে যেন ভাবতে না হয়—দল বা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে তারা ন্যায্য সুযোগ পাবেন না। এটা নতুন বছরের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। আমরা চাই আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্য দিয়েই সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনসাধারণের যোগসূত্র দুর্বল হয়ে গেছে। মানুষের সুখ-দুঃখটাও তাদের বুঝতে হবে। চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে হবে। আমরা সবাই একসঙ্গে মিলেই বড় হতে চাই।’

সংস্কার ও নির্বাচনকে ঘিরে এখনো কোনো ভালো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন না বলে জানান তপন চৌধুরী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে সেই পথে যে আমরা অগ্রসর হচ্ছি, সেটা দেখতে পাচ্ছি না, যদিও প্রাথমিকভাবে আমরা খুব আশাবাদী ছিলাম। সংস্কারের প্রয়োজন অবশ্যই আছে কিন্তু একবারে এতগুলো বিষয়ে, কেমন যেন সব লেজেগোবরে হয়ে যাচ্ছে। সব সময় যারা সংস্কারের কথা বলছি, তাদের এখনো অনেক শেখার আছে। হুট করে একটা দায়িত্ব নিয়ে দেশ চালানো এত সোজা না। একটা সংসার চালাতে গিয়ে, একটা ব্যবসা চালাতে গিয়ে মানুষ হিমশিম খেয়ে যায়। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে দেশ চালানোর কাজটা রাজনীতিবিদরাই করবেন। দিনের শেষে তারাই, কারণ বছরের পর বছর তারা এ ক্ষেত্র নিয়েই কাজ করেছেন। আমরা চাই স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচিত হয়ে তারা আসবেন। একটা ন্যায্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকার যত দ্রুত আসবে ততই ভালো। এটা দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। এভাবে মানুষেরও আস্থা ফিরে আসবে। এখন মানুষ অনেক দোটানার মধ্যে আছে। তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে, বুঝতে হবে যে এত সহজেই কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। উদাহরণ সৃষ্টি করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে যেতে হবে। আমরা এ রকমই চাই।’

দেশে শিল্প ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিত হয়নি। স্থিতিশীলতা ফেরেনি মুদ্রার বিনিময় হারে। বিনিয়োগ উদ্যোগ থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন বছরে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও সেগুলোর অর্জন নিয়ে সংশয় দূর হয়নি। আবার বৈশ্বিক ভূরাজনীতির প্রভাব নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়ে গেছে। দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশের কাছাকাছি। অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এসব গণদ্রব্যের দাম কমানোর সুযোগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। যদিও বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির মতো গণদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ আগের পদ্ধতিতেই চলছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘নতুন বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। আবার সে অনুযায়ী কতটা অর্জন করতে পারব সেটা নিয়ে সংশয়ও আছে। এখন বিষয় হলো দেশের ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি আসলে কেমন হতে চলেছে ও হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কথা যদি বলি, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট কাজ শুরু করার পর নতুন বছরে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে। এদিকে দেশে এখনো স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী। তবে প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় বাড়াটা একটা ভালো খবর। এখন বিনিময় হারের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনা না গেলে আমাদের জন্য অনেক কঠিন হবে। তাই সরকারের এ দিকটায় বাড়তি মনোযোগ দরকার। আমদানি প্রতিস্থাপক কিংবা যেসব খাতকে ঘিরে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, সেসব খাতের নীতি পরিবর্তন বা গঠন দক্ষতার সঙ্গে করাটা জরুরি। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমছে।’

চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ না পাওয়াটাকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি এরই মধ্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। ২০২৫ সালেও এ জ্বালানি সমস্যা মিটবে কিনা সেটা সরকারের পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে। শিল্পে জ্বালানি নিশ্চিত না হলে নতুনভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত কীভাবে হবে। সামাজিক স্থিরতা আনতে নতুন বছরে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করাটা অগ্রাধিকার পাওয়ার প্রত্যাশা রাখি। এত দুর্যোগ গেছে, আমি কখনই বিনিয়োগ বন্ধ রাখিনি। তাই সব সময়ের মতো করে নতুন বছরেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করি।’

নতুন বছরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী, সেটার একটা রোডম্যাপ থাকা জরুরি বলে মনে করেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ও ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী। নতুন বছরের প্রত্যাশার বিষয়ে বণিক বার্তাকে এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘২০২৫ ও ২০২৬ সালে সরকার ব্যবসায় কোন কোন জায়গায় গুরুত্ব দিতে চায় সেগুলো তুলে ধরতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরকার প্রণোদনা দিত, এখন সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এসব জায়গায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার কী ধরনের সহযোগিতা দিতে চায় তার পথরেখা থাকা জরুরি। এজন্য ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের সঙ্গে বসতে হবে।’

বাংলাদেশে জাহাজ শিল্প একটি বড় খাত উল্লেখ করে আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ খাতে সরকার ট্যাক্স মওকুফ করেছিল। এখন তা বাতিল করা হয়েছে। ফলে কোনো খাতকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। এছাড়া বাজারে বড় একটি সংকট হলো মূল্যস্ফীতি, এ সংকট কাটাতে হলে এখানে যেসব অনিয়ম হচ্ছে, সেগুলো কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বিশেষ কয়েকটি গোষ্ঠীর কারণে এসব সংকট তৈরি হচ্ছে। তার খেসারত দেশের সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কেন দিতে হবে? ইন্ডাস্ট্রিগুলো নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী, সেগুলো এখন পরিষ্কার হওয়া দরকার। সরকারকে এ পথনির্দেশনা তৈরি করতে হবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে। তাহলে নতুন বছরে দেশের ব্যবসায়ী খাতে প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।’

বিদেশী বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৪ সাল ছিল একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের বছর। অর্থনৈতিক মন্দা, বন্যা ও তাপপ্রবাহের মতো পরিবেশগত দুর্যোগ এবং জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কারণে দেশ অচল হয়ে পড়ে এবং একটি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে—এসব বাধার কারণে বছরটি অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যকে তিন ধরনের ভিন্ন অংশীদার ও পরিবেশের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে। একটি নির্বাচনের আগে, একটি নির্বাচনের পরে, সবশেষ অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে যে ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা ভবিষ্যতের জন্য বড় আশা দেখাচ্ছে। তবে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা, শ্রম অধিকার এবং জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রেখে স্থিতিশীলতা আনা সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এ স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হলে আস্থার অভাবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ সম্ভাবনাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তারা ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি, প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থার মধ্যে কিছু দৃশ্যমান ও স্পষ্ট উন্নতির আশা করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরিতে প্রভাব ফেলতে পারে। এটি কোম্পানিগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য নীতি সম্পর্কে আস্থা তৈরি করতেও সহায়তা করবে বলে মনে করেন বিদেশী বিনিয়োগসংশ্লিষ্টরা।

এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রা বিনিময় হারের ওঠানামা উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ধারা বাজারের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সমন্বয় হলেও হঠাৎ এবং তীব্র পতন ব্যবসা ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে। কারণ মুদ্রার পূর্বাভাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া ব্যবসার পরিকল্পনা সংক্ষিপ্ত সময়ে সমন্বয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অধিকন্তু আমদানিনির্ভরতার কারণে আমাদের মূল্যস্ফীতি শিগগির কমার সম্ভাবনা নেই, বরং পরিচালন ব্যয় আরো বাড়তে পারে। বিদেশী মুদ্রায় লেনদেন করা কোম্পানিগুলো বাড়তি খরচের মুখোমুখি হবে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো তহবিল ব্যয়ের বাড়তি চাপে টিকে থাকা কঠিন হবে।’

মোহাম্মদ জাভেদ আখতার আরো বলেন, ‘২০২৫ সালের বৈশ্বিক ব্যবসার পরিবেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বৈশ্বিক জ্বালানি এবং পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন হতে থাকবে। বাংলাদেশ একটি কঠিন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে এ পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে সামলাতে হবে। রূপান্তরকালীন এ বছরে পরিবর্তিত প্রবৃদ্ধি ও লাভের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। কঠোরভাবে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও নগদ অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে ধারাবাহিকতা, স্থিতিশীলতা এবং সরকারের বিনিয়োগ ও শিল্পনীতির ওপর বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রভাব থাকে। বিনিয়োগকারীরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বর্তমানে পর্যবেক্ষণ পরিস্থিতিতে আছেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে ভালো ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। যারা অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে।’

রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ব্যবসায়ীরাও ঐকমত্য সাপেক্ষে দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছেন। তারা মনে করেন, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রয়োজন। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী কী কী সংস্কার করবে, কখন ইলেকশন দেবে, এসব কিছু হওয়া প্রয়োজন। তবে তা যেন হয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আপাতত নির্বাচন কবে, কীভাবে হবে, এসব ঘিরেই প্রত্যাশা ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতি ও অর্থনীতি স্বাভাবিক হওয়ার ভাবনা থেকেই এসব প্রত্যাশা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা দেশের সাধারণ মানুষ। এটি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে নীতি সুদহার উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশে। যদিও মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো গত নভেম্বরে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ ছুঁয়েছে। আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে। অতিসংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে বেসরকারি খাত বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ সব শিল্পে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘রাজনৈতিক দিক থেকে প্রত্যাশা হলো আমরা চাই দেশে একটা গণতান্ত্রিক সরকার এবং এটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে। যখন সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্টগুলো দেবে, সংস্কার নিয়ে একটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কী কী সংস্কার করবে, কখন ইলেকশন দেবে, এসব বিষয়ে ঐকমত্যই আপাতত প্রত্যাশা যে কখন নির্বাচন দেবে। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বক্তব্য হলো আমাদের ব্যবসায়ী ভাই ও বন্ধুদের, যে বিদ্যমান পরিস্থিতি বহুবিধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনুকূল পরিবেশ না। এতৎসত্ত্বেও আমি বলব যে দেশের সর্বস্তরের জনগণের খাতিরে যেন কোনোভাবেই উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়। তারা যেন যথাযথ চেষ্টা করে ব্যাহত হওয়া এড়িয়ে উৎপাদন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বাজারে যেন পণ্যের ঘাটতি না থাকে। কারণ যারা পণ্য আমদানি করে তাদের কাছে মার্কেট রিপোর্ট থাকে। তারা জানে কোন পণ্য কখন আসবে। বিদেশে সেই পণ্যের কী দাম, দেশে কী দাম এবং কতটুকু দরকার। আমি চাই দুটি জিনিস, একটা হলো পণ্য সরবরাহে যেন কোনো ঘাটতি দেখা না দেয়, তাহলে তা উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকানি দেবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন ব্যবস্থা যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, যেন সচল থাকে। কারণ উৎপাদন যদি কমে যায় অর্থনীতি খারাপ হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি যদি আরো বাড়ে জিনিসপত্রের দাম আরো বেড়ে যাবে। অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় আছে, এর চেয়ে যেন আর খারাপ না হয়। জনগণ ও দেশের স্বার্থে আমাদের সর্বতোভাবে চেষ্টা করা উচিত কোনো পণ্যেরই যেন উৎপাদন না কমে।’

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে গেছে বলে মনে করেন বিএনপি আমলের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে। দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগে যাবেন না বলেও মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন না পাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়নের ফলে হ্রাস পেয়েছে কারখানাগুলোর উৎপাদন। এতে করে তাদের সামগ্রিক ক্রেডিট লাইন অর্ধেকে নেমে গেছে। উৎপাদন হ্রাসের এ ধাক্কায় বেকারত্ব সংকট তীব্রতর হবে। সুতরাং বিরাজমান এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এগুলোকে অ্যাড্রেস করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও আমরাই সমাধান করছি। এর পাশাপাশি অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি। ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে এবারই প্রথম নয়; এর আগে এক-এগারোর সময়ও এগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ক্রমান্বয়ে কঠিনতর পরিস্থিতির দিকে যাবে। অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের মুখ দেখবে না।’

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আরো বলেন, ‘পরবর্তী সরকারের পরিকল্পনা কী হবে? তারা কীভাবে সংকটের উত্তরণ ঘটাবে? অন্তর্বর্তী সরকারের সময় অন্যরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। এসব কিছুর পাশাপাশি একটি নির্বাচিত সরকারের অনুপস্থিতিতে প্রতিনিধিত্বের চরিত্রটি থাকে না বিধায় রাজনৈতিক ওয়েটও থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সমস্যার ফিডব্যাক পেতে হয়; তারা সবাই বিচ্ছিন্ন থাকায় এখন তা অনুপস্থিত। এ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন খুব দ্রুত নির্বাচনী সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে চলে যাওয়া। অন্য সংস্কার করা তো তাদের দায়িত্ব না। ওইসব সংস্কারের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্র লাগবে। মানুষের ম্যান্ডেট লাগবে। এগুলো সংসদে উত্থাপন করে তার ওপর আলোচনা হবে; বিতর্ক হবে। তারপর সংস্কার হবে। কিছু লোক বসে সংস্কার করলে এটির বৈধতা থাকবে না। জনগণের কাছে তো যেতে হবে। তবে তাদের কিছু রিকমেন্ডেশন থাকতে পারে। সেগুলোও সংসদের যে প্রক্রিয়া আছে সেটির মধ্য দিয়েই পাস হবে।’ 

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর