পারিবারিক কাজেও ব্যবহার করছেন অনেকে বেবিচক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বেশি এগিয়ে অ্যাম্বুলেন্সও ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত কাজে
সরকারি গাড়ি ব্যবহারে বিলাসী আচরণ করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তারা সরকারি গাড়ি অফিসের কাজের চেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে। তারা সন্তানদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে বাজার করার কাজেও ব্যবহার করছেন সরকারি যানবাহন। এ কাজে তারা কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করেন না।
প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই তাদের এ কাজে। তারা সরকারি যানবাহনের বিধিবহির্ভূত ব্যবহার করেই যাচ্ছেন। এ কাজে এগিয়ে রয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), পুলিশ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বড় কর্তা হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। কোনো কোনো গাড়িচালক এ কারণে কিছু কর্মকর্তার ওপর নাখোশ। কারণ ওই কর্তারা ছুটির দিনে তাদের নিয়ে যান পারিবারিক কাজে। অ্যাম্বুলেন্সও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, জনগণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করে সরকারি কর্মকর্তারা রাজার হালেই আছেন। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন কিন্তু প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও সেগুলোর বেশিরভাগ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে সরকারি পরিবহন পুলে গড়ি জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। গত চার অর্থবছরে ১২২৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রায় বিশ হাজারের মত গাড়ি ব্যবহৃত হলেও জমা পড়েছে মাত্র ১৩৮টি। বাকি গাড়িগুলো এখন অবৈধভাবে চালাচ্ছেন কতিপয় কর্মকর্তা। এতে জ্বালানি ও চালক এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ রাষ্ট্রের খরচ হচ্ছে কয়েকশ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিয়মের তোয়াক্কাই করছেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, সরকারি গাড়ি ব্যবহারে যেমন খুশি তেমন আচরণ করছেন কর্মকর্তারা। সরকার অর্থসংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। আইনে বলা আছে, অফিসের কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। অথচ প্রায়ই অফিসের কাজের গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন সন্তানকে স্কুল বা কলেজ বা বিশ^বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া, বাজারঘাট করা প্রভৃতি কাজে গাড়িবিলাস করছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও প্রকল্পে সরকারের কতগুলো গাড়ি আছে তার সঠিক সংখ্যা জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। পরিবহন পুল বলছে, মোট সরকারি গাড়ির মাত্র ১০ ভাগ সরবরাহ করেন তারা। বাকি ৯০ শতাংশই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের যান। তবে প্রকল্প শেষ হলেও নিয়ম মেনে গাড়ি জমা পড়ে না পুলে। এসব অনিয়মে এগিয়ে আছে পুলিশের সবকটি ইউনিট, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেচিক), সিটি করপোরেশন, এলজিআরডিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা। গত ১৫ বছরে নানা অনিয়ম হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও একই অবস্থা। গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে যদিও গাড়ি ব্যবহারের কিছু নির্দেশনা জারি হয়েছে।
তাতে বলা হয়েছে, সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের বেশ কিছু কর্মচারী প্রচলিত বিধি ও প্রাধিকার বহির্ভূতভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা, ব্যাংক-বীমা, কোম্পানি থেকে অধিযাচন করে গাড়ি নিয়ে আসছে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার পরও অনৈতিক ও বিধি বহির্ভূতভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারীর প্রাধিকার বহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক অপচয়ের কারণ ঘটছে, অন্যদিকে সমাজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের দায়িত্বসচেতনতা সম্পর্কেও জনমনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহার করছেন। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়।
সূত্র জানায়, সরকারি কর্মকর্তাদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আনা-নেওয়া, শপিং মল থেকে শুরু করে কাচা বাজারেও সরকারি গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কারণে চালকরা ছুটি পান না। তাদের এসব কাজে অপেক্ষমান থাকতে হয় ছুটি হওয়া পর্যন্ত। আর এসব কাজে এসি চলে, পুড়ে জ্বালানি। প্রায়ই দেখা যায় গাড়ি না চললেও চালকরা এসি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করছেন। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্টান, অফিস ও মার্কেটে সরেজমিনেও দেখা গেছে সরকারি যানবাহন ব্যবহার করছেন কর্মকর্তাদের স্বজনরা। সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সারাদেশে সরকারি অফিসে যানবাহন সরবরাহের কাজটি করে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর। এসব কাজে তদারকি নেই।
এ প্রসঙ্গে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গাড়িগুলো জমা পড়লেই আমরা নিতে পারি। আমাদের এমন কোনো কৌশল নেই যাতে আমরা তাদের বাধ্য করতে পারি বা প্রকল্প শেষে গাড়ি জমা নিতে পারি। আমাদের অনুকুলে কোনো আইন নেই। আমাদের কিছু করার থাকে না। তবে আমরা নিয়মিত তথ্য পাচ্ছি, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা অফিসের গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। বিষয়টি উর্ধ্বতন মহলকে জানানো হয়েছে। প্রবিধান অনুযায়ী যারা গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন না, তারাও ব্যবহার করছেন, প্রয়োজনীয় জ্বালানির অতিরিক্ত তারা ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরাও জনগণের করের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করছেন। যারা এসব করছেন তাদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, সরকারি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটছে। দুর্ঘটনায় পড়লে নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়। একটি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ সময় সরকারি দামী গাড়িগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ৪০টি দামী গাড়িসহ কমপক্ষে ৭০টি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্ঘটনায় শিকার হয়ে অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া গাড়িগুলোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই নেই। এতে কয়েক কোটি টাকার সরকারি সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। এসব গাড়ির জ্বালানি তেল বেশি যাচ্ছে সরকারি কোষাগার থেকে। জেলা পর্যায়ে উপ-পরিচালক এবং সহকারী পরিচালক (সিসি) একটা করে গাড়ি ও এডিসিদের জন্য ৬৪টি পাজেরো স্পোর্টস গাড়ির একই অবস্থা।
একই দশা বেবিচকেও। সংস্থাটির বড় বড় কর্মকর্তারাও সরকারি গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। কাউকে কাউকে দুই থেকে ৬টি পর্যন্ত গাড়ি বরাদ্ধ দেওয়া আছে। এ নিয়ে সাধারণ কর্মচারীরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন। তারমধ্যে একটি গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হয়। একই সংস্থার সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন। যেখানে পরিচালকরা যানবাহনের অভাবে গাড়ি পাচ্ছেন না, সেখানে সহকারী পরিচালক বা উপ পরিচালক প্রাপ্যতা না থাকার পরও অবৈধভাবে সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহার করছেন। সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর ও উপ-পরিচালক, রাহাত মাহমুদ নানা কায়দায় অফিসের গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। পুলিশও পিছিয়ে নেই। পুলিশ কর্মকর্তারা সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্টানে আনা-নেওয়ার পাশাপাশি বাজারঘাট করার জন্যও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন।
মন্তব্য করুন: