গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়রের হাজার কোটি টাকারও বেশি অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন দল বদল, আর ক্ষমতার পাশাপাশি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদুর রহমান কিরণ।
২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। নগরীর ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদুর রহমান কিরণ তখন ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান। তারও আগে বিএনপির সমর্থনে নির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে একাধিকবার বরখাস্ত করা হলে তখনো দীর্ঘ সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন কিরণ।
অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত মেয়রের চেয়ারে বসে কিরণ দুর্নীতি-লুটপাট, কমিশন বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি দেশে-বিদেশে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েন এবং নেন বিদেশি নাগরিকত্ব। তিনি নিজের ও স্ত্রীর নামে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তিনটি বাড়ি কিনেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নজর পড়ে পুবাইলের চিরুলিয়ায় অর্পিত সম্পত্তির ওপর। সেখানকার ২৩ বিঘা জমি নিজের কবজায় নেন কিরণ। এর জন্য ভুয়া জমির মালিক বানান একজনকে। এ জমি নিজের করায়ত্তে নিতে সিটি করপোরেশনের ১৮ লাখ টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হলে পরে কর পরিশোধ করেন। তবে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জমির মালিক হওয়ায় ওই জমির খাজনা এখনো দিতে পারেননি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিরণ ২০১৬-১৭ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় একটি টেন্ডার আহ্বান করেন। টেন্ডার নম্বর : জিসিসি/জেড। ওই টেন্ডারের কাজের অগ্রগতি না থাকায় পরবর্তীতে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হলে ওই টেন্ডারের কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি। ২০২১ সালে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বিল পরিশোধের উদ্যোগ নেন কিরণ। ওই সময়ের বিভিন্ন ঠিকাদারকে ডেকে তাদের কাছ থেকে কাজের হিসাব করে তার কমিশন আদায় করেন কিরণ। রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডে ১০ নম্বর বাড়ির ছয় তলায় তিনি একটি কার্যালয় করেন। উত্তরার এ কার্যালয়ে বসে ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন হাই কোর্ট।
এদিকে গত ১৮ নভেম্বর রাতে যশোরের শার্শা সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে টঙ্গী, গাজীপুর, রাজধানীর উত্তরা থানাসহ বিভিন্ন থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, খুন ও আহতের ঘটনায় সাতটি মামলা রয়েছে। দুদক সূত্র জানায়, গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অঢেল সম্পদ পাওয়া গেছে কিরণের। এরপর সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। টঙ্গীর পাগাড়, ঢাকার আশুলিয়া এবং গাজীপুরে নিজ নামে, স্ত্রী, শ্যালক ও শ্যালিকার নামে ১১২ বিঘা জমির মালিক কিরণ। রাজধানীর উত্তরায় ১১ নম্বর সেক্টরে ৭ নম্বর রোডের ১০ নম্বর সাত তলা বাড়ি, ৭ নম্বর সেক্টরে ১৮ নম্বর রোডে ৯৫ নম্বর ১২ তলা বাড়ি, গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কে একটি ভবনে ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, এর আনুমানিক বাজারমূল্য ১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় স্ত্রী ও নিজের নামে অন্তত ২০০ বিঘা জমির ওপর কারখানা রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা। টঙ্গীতে আছে ৩টি ফ্যাক্টরি, যার আনুমানিক মূল্য ৩০০ কোটি টাকা।
পাচার করা টাকায় নিউইয়র্ক শহরে নিজ নামে, স্ত্রীর নামে কিনেছেন বাড়ি। অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট দুদকের কর্মকর্র্তারা বলছেন, যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে কিরণের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ ফাইল চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় কমিশন না থাকায় সেই ফাইল অনুমোদন হয়নি। এখন নতুন কমিশন এসেছে, যে কোনো সময় তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের মামলা হবে। জানা গেছে, প্রিন্টিং প্রেস কারখানায় বাইন্ডার ম্যান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন আসাদুর রহমান কিরণ। ১৯৮৪-৮৫ সালে এলিট প্রিন্টিং প্রেস নামে ওই কারখানায় চাকরি করা কিরণ ১৯৮৬ সালে রাজনীতিতে আসেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টির যুব সংগঠন যুব সংহতির টঙ্গীর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পরে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির রাজনীতিতেও যুক্ত হন। এরপর টঙ্গী, পাগাড় মৌজায় হিন্দু-খ্রিস্টানের মালিকানায় থাকা জমি দখল করে নেন তিনি। পরে প্লট বানিয়ে চড়া দামে বিক্রি করেন। পাগাড় শিল্পাঞ্চল এলাকা হওয়ায় ওই এলাকায় টার্গেট করে জমি দখল করেন কিরণ।
টঙ্গী পৌরসভা হিসেবে প্রথম ভোটে ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কমিশনারও নির্বাচিত হন। তত দিনে ক্ষমতা-সম্পদ ও অঢেল অর্থের মালিক হয়ে ওঠেন তিনি।
মন্তব্য করুন: