রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে উভয় পক্ষের এমপিরা স্বাধীনভাবে ভোট দেবে, ঐকমত্য কমিশনে এমন প্রস্তাব বিএনপি করেছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে নাগরিক ঐক্যর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব এনেছি এবং সব দল ঐক্যমত হয়েছে। এবং আমরা আরেকটি প্রস্তাব করেছি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গোপন ব্যালোটের মাধ্যমে উভয় পক্ষের স্বাধীনভাবে ভোট দেবে। সেটা আরেকটা বিপ্লব হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর করার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছি, এটাও বড় ধরনের অর্জন নয়! আমরা যদি প্রতিক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগকে সীমাবদ্ধ করি, আইনিভাবে সাংবিধানিকভাবে তাইলে কিন্তু নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হবে। তখন রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করা যাবে না। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা যার যার সীমাবদ্ধর মধ্যে থেকে কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রকৃতপক্ষে সংস্কার হবে। আমরা এমন সংস্কার চাই।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকতে হবে সেটা এনসিএন স্টেট হয়েছে। সেজন্যই আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর সংগ্রাম করেছি। স্বচ্ছ নিরপেক্ষ এবং নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবাধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি সত্যিকার স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে এখানেই কিন্তু স্বৈরাচারের উৎপত্তিটা বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করার মধ্য দিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী দাঁড় করানো যাবে না।
তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগকে খর্ব করার মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো দাঁড় করানো যাবে না। নির্বাহী বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কাজ করতে দিতে হবে। বিচার বিভাগ ও আইন সভাকে তার কাজ কাজ করতে দিতে হবে। আর সেখানে থাকবে একটা কমপ্লিট চেক অফ পাওয়ার। একটা সেপারেশন অফ পাওয়ার থিওরির যেটা মূল কথা। তাহলে কোনো অর্গান অন্য অর্গানসের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। একটা আরেকটা ব্যালেন্সিং অফ পাওয়ার অর্থাৎ পাহারাদার হিসেবে কাজ করে সেই কথাগুলোই আমরা অবিরত ভুলে যাচ্ছি। এখন একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে নির্বাহী বিভাগকে যতটা নিয়ন্ত্রিত করা যায়।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, অতীতে একজন সরকার হয়েছিল বলে আমরা নির্বাহী বিভাগকে বিলুপ্তি করতে পারব না, দুর্বল করতে পারবো না। একজন সংসদীয় পদ্ধতিতে আমরা আইন সভা কে বিলুপ্তি করতে পারব না। আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে চেক এন্ড ব্যালেন্স এবং একটা হারমোনিয়াস কোঅপারেশন একটা মধুর সম্পর্ক এবং পাহারাদার সৃষ্টি করা, সেফগার্ড সৃষ্টি করার জন্য সব অর্গানগুলোকে সেভাবে শক্তিশালী করা। সব গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে একটা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাড়া করানো যাতে তারা নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তাহলে এদেশে আর কোনোদিন স্বৈরাচারের উৎপত্তি হবে না।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, শুধুমাত্র আর্টিকেল ৯৬ এ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা আছে। সেই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একজন বিচারককে শুধু অপসারণ করা যায়। কিন্তু অপসারণ শুধুমাত্র ইউনিটি মেজারস হতে পারে না। একমাত্র শাস্তি হতে পারে না। যদি এখানে ইন্ডিভিজুয়াল ক্রিমিনাল লায়েবিলিটি থাকে সেটা ফিক্স করার জন্য যথাযথ আইন থাকতে হবে। অধস্তন আদালতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটা সেক্রেটারি নির্মাণ যথেষ্ট নয়। সেই সেক্রেটারিটের মধ্য দিয়ে অবস্থান আদালত সমূহের তাদের জবাবদিহিতা এবং বিভিন্ন মিসকন্ডাক্টের জন্য তাদেরকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই বিধান থাকতে হবে। অবশ্য আছে বলে মনে করি। কিন্তু সেটা আমরা দেখতে চাই অবশ্যই এখনো পর্যন্ত সেটা পূর্ণাঙ্গরূপ পায়নি।
তিনি বলেন, জুডিশিয়ারি ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ট্রান্সপারেন্টলি বিচারক নিয়োগ হবে এবং তারা এক পর্যায়ে এফিলিয়েট ডিভিশনে যাবে সেখান থেকেই চিফ জাস্টিস হবে। এভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা যে ঘুনে ধরা ব্যবস্থা ছিল সেটার সংস্কার হবে। ওভারনাইট হবে না। আমি শুধু রক্ষা কবজ হিসেবে জুডিশিয়ারির কথা বললাম। কিন্তু রক্ষাকবজ হিসেবে এইটা এখানে এই প্রেসক্লাব ফ্রিডম অফ প্রেস সবচাইতে বেশি জরুরি। যে দেশে ফ্রিডম অফ প্রেস শতভাগ, সেই দেশে গণতন্ত্র শতভাগ সেটা আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে।
সকল রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে সালাহউদ্দিন বলেন, আপনারা কেউ চাইবেন কল্যাণমূলক রাষ্ট্র আরেকজন চাইবেন অকল্যাণমূলক রাষ্ট্র এগুলো যেন না হয়। আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তি....সেটা আদর্শ যাই হোক সবার মধ্যে যেন একটা কমন আদর্শ থাকে যে আমরা সবাই জনগণের মুক্তি চাই। সবাই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। সবাই কল্যাণ রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চাই। সবাই শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চাই। বৈষম্যহীন সাম্যভিত্তিক মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক সামাজিক সুবিচারের রাষ্ট্র চাই। এখানে যেন আমরা সবাই কার্যত এক হতে পারি। ভাষণের মধ্যে নয়। কারণ এই দেশে আমরা ভাষণ অনেক দিয়েছি। এখন আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছি যেই জায়গায় শহীদের রক্ত। পিচ্ছিল রাজপথের উপরে তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক, প্রত্যাশা ছিল অনেক। সে আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যেন আমরা পূর্ণ করতে পারি। এবারের শহীদের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা যদি আমরা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ আর দেখি না।
তিনি বলেন, আপনারা এখানে সংস্কার নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন কিন্তু হতাশা কেউ ব্যক্ত করেন নাই। কারণ আমরা সবাই আশাবাদী মানুষ। আলাপ আলোচনা চলছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমরা একটা জায়গায় ঐক্যতে আসতে পারবো। আমরা ঐক্যতে আসার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে কি কি বিবেচনা নিয়েছি জাতীয় স্বার্থ আপনারা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছেন। আমরা বলেছি ১০ বছরের বেশি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে বসতে পারবেন না। এখানেই স্বৈরাচারকে রুখে দেয়া হলো।
আলোচনা সভায় বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনকে দাপট মুক্ত করতে হলে ধর্মের অপব্যবহার, প্রশাসনের দলীয়করণ করা বন্ধ করতে হবে। জুলাই মাসেই সব দলকে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করার আহ্বান জানান।
জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের উদ্দেশ্য কী, মনে কি আছে? গত১৬ বছর দেশের জনগণ ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেছে। কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করেনি। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গেলে অন্তত এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে। তাই এসব খেলা বন্ধ করেন। দড়ি নিয়ে বেশি টানাটানি না করি। কারণ বেশি টানাটানি করলে দড়ি ছিড়ে যাবে। এসময় নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় নির্বাচনের পথে হাঁটার আহ্বান জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহামুদুর রহমান মান্না সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন ১২ দলীয় জোটপ্রধান ও জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্য সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ্ কায়সার, ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবুল প্রমুখ।
সোর্স: আমার দেশ
মন্তব্য করুন: