একচেটিয়াভাবে নবজাতককে মায়ের দুধ পান কমে গেলে শিশু অপুষ্টি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে স্তন্যপান না করালে মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) পরিচালক ও বিএনএফ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান।
গতকাল বুধবার বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুখ্য আলোচক হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মায়ের প্রথম দুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক টিকা হিসেবে কাজ করে। এতে থাকে অ্যান্টিবডি, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল, যা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া শিশুর বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা হওয়ার ঝুঁকি কমায়।
ডা. মজিবুর রহমান জানান, মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিশুখাদ্য শিল্পের আগ্রাসী বিপণন। বাজারে পাওয়া ফর্মুলা মিল্ক ও প্যাকেটজাত দুধের বিজ্ঞাপন অনেক মাকে বিভ্রান্ত করছে। দ্বিতীয়ত, মাতৃত্বকালীন ছুটি কম হওয়ার কারণে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমেছে। সরকারি চাকরিজীবীদের ছুটি তুলনামূলক দীর্ঘ হলেও বেসরকারি খাতে তা মাত্র তিন-চার মাস, ফলে মায়েরা আগে থেকেই দুধের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হন। এ ছাড়া প্রসূতি মা ও পরিবারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতিসহ পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমছে।
বিএনএফের সভাপতি অধ্যাপক মো. মাহবুবুল হক বলেন, বাংলাদেশে যদি সব শিশুজন্মের পর প্রথম ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ পেতে শুরু করে এবং ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধ পান করে, তাহলে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
বিএনএফের উপদেষ্টা অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন বলেন, মাতৃদুগ্ধ পানের হার বাড়াতে হলে বেসরকারি খাতে অন্তত ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা; সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে স্তন্যদান কর্নার স্থাপন; শিশুখাদ্য বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন প্রয়োগ; গর্ভাবস্থা থেকেই মায়েদের পুষ্টি ও স্তন্যপান বিষয়ে প্রশিক্ষণ এবং পরিবার ও কর্মস্থলে স্তন্যপান-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
বিপিএস মহাসচিব অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। এটি শুধু খাদ্য নয়, এটি জীবন রক্ষাকারী প্রতিষেধক। যে দেশ যত বেশি মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করতে পারে, সে দেশের শিশুমৃত্যুর হার তত কম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে যেখানে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত একচেটিয়াভাবে মায়ের দুধ পান করত প্রায় ৬৪ শতাংশ শিশু, সেখানে ২০২২ সালে এ হার নেমে আসে ৫৫ শতাংশে। অর্থাৎ এক দশকে প্রায় ৯ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে মাতৃদুগ্ধ পানের হার। সম্প্রতি আট বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জন্মের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পায় গড়ে ৪৯ শতাংশ শিশু।
মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে কৌটাজাত গুঁড়া দুধ খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়ার অপরাধে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা ও সাজা দেওয়ার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ অপতৎপরতা বেড়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা।
সোর্স: কালবেলা
মন্তব্য করুন: