ajbarta24@gmail.com বৃহঃস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি ২০২৫
২৬ পৌষ ১৪৩১

অভ্যুত্থানে নিখোঁজ-বেওয়ারিশদের সন্ধানে উদ্যোগ অপ্রতুল

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:০১ এএম

ফাইল ছবি

একমাত্র সন্তান মারুফ আহমেদকে (১৭) নিয়ে দুপুরে খাবার খাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন মা মৌসুমী আক্তার। নিজের হাতে রান্না করে ফোন দেন ছেলেকে। “এখনই আসছি” বলে ফোন রেখে দেয় মারুফ। সেই ছেলে আর ফিরে আসেনি। গত ২১ জুলাই থেকে মারুফের খোঁজ মিলছে না। রাজধানীর রূপনগর এলাকার এই মায়ের সেই যে অপেক্ষা তা শেষ হচ্ছে না।

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মৌসুমী আক্তার। তিনি জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় নিখোঁজ স্কুল শিক্ষার্থী মারুফ আহমেদের মা। রূপনগর, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪।

মৌসুমী আক্তার জানান, “আমার ছেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে। ২১ জুলাই সকাল ১০টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয় সে। ওর গায়ে ছিল কালো গেঞ্জি।”

মৌসুমী জানেন না আদৌ তাঁর সন্তান বেঁচে আছে কিনা।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলছিলেন, “আমি ওকে বেলা একটার দিকে ফোন করি, জানতে চাই সে কোথায়। ও বলে, আমি রূপনগর হাউজিং এলাকায়।”

“তারপর দেড়টার দিকে ফোন করে বলি, আমি পাঙাস মাছ রান্না করেছি। তুমি আসো, একসঙ্গে খাবো। আমি আসছি বলেই ফোন কেটে দেয় মারুফ। তারপর থেকেই ফোন বন্ধ,” কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ছেলের শোকে বিহ্বল মা মৌসুমী।

মারুফের মতো অনেকেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের খবরে গত ৫ আগস্ট আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে যান পোশাককর্মী মনিরুজ্জামান মিলন (৩০)। সেদিন বিকেল তিনটার দিকে স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় তার। এরপর আর খোঁজ মেলেনি মিলনের।

তার বড় ভাই সামিউল হোসেন বলেন, “পরদিন থেকে আমরা আশুলিয়া ও ঢাকার সকল হাসপাতাল-ক্লিনিক, মর্গসহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় মিলনের খোজে গিয়েছি। এখনো খুজে বেড়াচ্ছি।”

“আমি জানি না আমার ভাইয়ের কী হয়েছে। সে কি বেঁচে আছে না মারা গেছে। ভেবে পাই না তার একমাত্র সন্তান ও স্ত্রীকে কী বলে সান্তনা দেবো” বলেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার আহত ও শহীদদের স্বজনদের জন্য নানা উদ্যোগ নিলেও নিখোঁজদের সন্ধানে এবং বেওয়ারিশ মরদেহগুলোর পরিচয় উদ্ধারে এখনো দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

গত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নিহত অনেককেই বেওয়ারিশ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানসহ রাজধানীর কয়েকটি স্থানে দাফন করা হয়। এ কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম।

মানবাধিকার কর্মীদের ধারণা, অভ্যুত্থানে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের বড় অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে বেওয়ারিশ লাশ।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তারা জুলাইয়ে ৮০ জন এবং আগস্টে ৩৪ জনের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে। সংস্থাটির ধারণা, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা অনেকেই আন্দোলনে নিহত হলেও সংখ্যাটি এখন পর্যন্ত অজানা।

নিখোঁজদের খুঁজে পেতে চিঠি

নিখোঁজদের খুঁজে পেতে এবং অজ্ঞাত মরদেহের পরিচয় উদ্ধারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কেনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি-তা জানতে চেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন দুই তরুণ।

তাদের একজন ইমরান মাহফুজ বলেন, “নিখোঁজ এবং বেওয়ারিশ পরিচয় নির্ণয় করার দায়িত্ব কার? নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের? রাষ্ট্রকে আমরা আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে দেখিনি।“

“এ অবস্থায় আমি এবং আমার বন্ধু আরাফাত মিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাই, আপনারা কি উদ্যোগ নেবেন? কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত উত্তর পাইনি,” জানান ইমরান।

কমিটি গঠনের পরামর্শ

মানবাধিকার কর্মীরাও বলছেন, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা ব্যক্তিদের কবরগুলো সংরক্ষণও করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে নিহতদের সঠিক সংখ্যা বের করা আরও কঠিন হবে।

নিখোঁজদের সন্ধান করা ও বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিতে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “নিহত, নিখোঁজ বা বেওয়ারিশদের সঠিক সংখ্যা বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। না হলে এই দেশের জন্য এত বড় অবদান রেখেছে তাদের সঠিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না।”

সরকার সম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে নিহত ৮৫৮ জনের প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের এই পরিসংখ্যান সরকারি হিসেবে নিহতদের সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ।

সহযোগিতা না পাওয়া অভিযোগ

একমাত্র সন্তানকে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি ১৪ আগস্ট রূপনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মৌসুমী আক্তার। তবে পুলিশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁর।

মৌসুমী বলেন, “আমার ছেলে এখন কোথায় আছে? কী অবস্থায় আছে? সবাই বলে, ‘আমি খোঁজ দিচ্ছি, মারুফের জন্য কিছু করব।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ কিছু করেনি। কেউ কোনো খবর এনে দিচ্ছে না।”

১৪ বছর আগে স্বামীকে একমাত্র সন্তান মারুফকে নিয়েই জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মৌসুমী বলেন, “আমার একটিই সন্তান। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না, ধৈর্য্যও ধরতে পারছি না।”

মারুফ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে রূপনগর থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. ইব্রাহিম বলেন, “তার ফোনটির শেষ লোকেশন সিলেটের মৌলভীবাজার ছিল বলে জানতে পেরেছি। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি, বিষয়টি তদন্তাধীন আছে।”

নিখোঁজ মনিরুজ্জামান মিলনের ভাই সামিউল বলেন, “পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করছে না, একটা জিডি পর্যন্ত নেয়নি। আমি ও আমার ভাইয়ের স্ত্রী তিনবার আশুলিয়া থানায় গিয়েছি। জিডি করতে পারিনি। তাহলে রাষ্ট্রের কাছে আমরা কী সহযোগিতা আশা করব,” হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।

এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামাল হোসেন বলেন, “মনিরুজ্জামান মিলন নামে কেউ নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে নেই।”

জিডি গ্রহণ না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “এমনটি হওয়ার কথা নয়। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে এই থানাতেই (আশুলিয়া) সবচেয়ে বেশি মামলা (৬৮ টি) গ্রহণ করা হয়েছে।”

সরকার যা করছে

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের তথ্য এই বিশেষ সেলকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ডা. মো. সায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, “সাধারণভাবে মানুষ নিখোঁজের বিষয়ে পুলিশকে জানাতে অভ্যস্ত। নিখোঁজের তথ্য থানায় আছে, ওখান থেকে তথ্যগুলো আমাদের কাছে সরাসরি পৌঁছায়নি।”

“আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে আমরা জানাচ্ছি যে, কেউ সরাসরি নিখোঁজের সংবাদ আমাদের জানাতে পারেন এবং কেউ যদি কোনো কবরের খবরও জানেন, তা জানাতে পারেন,” বলেন তিনি।

সায়েদুর রহমান স্বীকার করেছেন, অজ্ঞাত ব্যক্তিদের পরিচয় উদ্ধারের কাজ বেশ জটিল বলে এই প্রক্রিয়া এখনো খুব গতি পায়নি।

“পরিচয় নির্ণয় করতে যে প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করা দরকার, তা হলো নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা। এ ছাড়া বেওয়ারিশ লাশ যেসব স্থানে দাফন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রধানত জানা গেছে রায়েরবাজার ও আজিমপুর সম্পর্কে। তবে ঢাকার বাইরেও কোনো কোনো জেলায় বেওয়ারিশ লাশ দাফন করার কথা জানা গেছে,” বলেন সায়েদুর রহমান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, “এই জায়গাগুলো চিহ্নিত করে, মরদেহের স্যাম্পল সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। এর আইনি প্রক্রিয়াও জটিল। তবে আমরা ডিএনএ বিশ্লেষণ করতে পারব যদি স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়।”

কৃতজ্ঞতা: বেনার

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর